বিদেশের মিশনগুলোতে হয়রানি আর অনিয়ম বাড়ছে

0
114
Print Friendly, PDF & Email

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাইকমিশনে দিন দিন অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা বাড়ছে। ফলে প্রবাসে থাকা নানা পেশার বাংলাদেশীরা এখন হতাশ ও ুব্ধ। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা, জনশক্তি রফতানি ও ব্যবসায়বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য যাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছে তারাই যাওয়ার পর আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ওই সব দেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ুণœ হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কিছু হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে লেবার কাউন্সিলর (শ্রম), প্রথম শ্রম সচিব ও অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সাথে অশোভন আচরণ, পাসপোর্ট কেলেঙ্কারি, হয়রানি, দুর্নীতি ও জালিয়াতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। যার কারণে তারা আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে এ ক্ষেত্রে দায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বছরওয়ারি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে ব্যর্থতার অভিযোগ মিললে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আর সফলতা থাকলে পদোন্নতি দিয়ে সেখানে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা অনেকটা কমে আসবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জনশক্তি রফতানি বাড়াতে ও দূতাবাসে অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে সম্প্রতি জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইরাকসহ ছয়টি দেশে কাউন্সিলর (শ্রম) এবং হংকং, মিসর, লিবিয়া থাইল্যান্ড, গ্রিসসহ ১৩টি দেশে প্রথম সচিব (শ্রম) পদে ২০ জন কর্মকর্তাকে নতুনভাবে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিগগিরই তারা ওই সব দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দিবেন। আবার কেউ কেউ ইতোমধ্যেই যোগ দিয়েছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: আব্দুস সালাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বদলিপূর্বক তাদের নামের পাশে বর্ণিত পদে প্রেষণে নিয়োগের জন্য তাদের চাকরি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: সায়েদুল ইসলামকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সিলর শ্রম উইং, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এ এস এম জাকির হোসেনকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলের কাউন্সিলর (শ্রম), অর্থ বিভাগের উপসচিব মো: সারোয়ার আলমকে সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মো: সিরাজুল ইসলামকে কাতারের দোহায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর, অর্থ বিভাগের উপসচিব এস এম জাকারিয়া হককে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাকের বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (বহির্গমন) আব্দুল লতিফ খানকে  কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়া হয়। অপর দিকে ১৩টি দেশে প্রথম সচিব (শ্রম উইং) পদে বিভিন্ন দেশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা হচ্ছেন, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমানকে দক্ষিণ আফ্রিকায়, রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রফিকুল করিমকে ইতালির মিলান দূতাবাসে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মনিরা বেগমকে হংকংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিবের একান্ত সচিব ড. মো: মোকছেদ আলীকে আবুধাবিতে, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব টি কে এম মোশফেকুর রহমানকে মালদ্বীপে, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো: আব্দুর রউফ মিয়াকে ব্রুনাই, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব বেগম জুবাইদা মান্নানকে মিসরের কায়রো দূতাবাসে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব বেগম শারমিনা নাসরীনকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব বেগম লুবনা সিদ্দিকীকে রাশিয়ার মস্কোয়, বিয়াম ফাউন্ডেশনে সংযুক্ত (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক চুয়াডাঙ্গা হিসেবে বদলির আদেশাধীন) সিনিয়র সহকারী সচিব মো: শরিফুল ইসলামকে স্পেনে, নরসিংদী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহম্মদ রবিউল ইসলামকে লিবিয়ার ত্রিপোলি দূতাবাসে, চাঁদপুর মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ কে এম মনিরুজ্জামানকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক দূতাবাসে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব ড. সৈয়দা ফারহানা নূর চৌধুরীকে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাসে শ্রম উইংয়ের প্রথম সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ইতোমধ্যে এসব কর্মকর্তার ওরিয়েন্টেশন কোর্স সম্পন্ন হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে পরপর দুইবার পাসপোর্ট চুরির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় কারা জড়িত তা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হলেও সেই প্রতিবেদন আজো আলোর মুখ দেখেনি। পাসপোর্ট কেলেঙ্কারি ছাড়াও প্রতিনিয়ত ভিসা রিনিউ, নতুন পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে আসা কর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর দুর্নীতিতো পদে পদে হচ্ছেই। অভিযোগ রয়েছে, দেশটিতে নিযুক্ত লেবার কাউন্সিলর মন্টু কুমার বিশ্বাস প্রায় চার বছর ধরে অবস্থান করেও শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। যার কারণে এখনো লেবার আইন অনুযায়ী বৈধ শ্রমিকেরা দেশটিতে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। মারা যাওয়া শ্রমিকদের লাশ নিয়েও বাণিজ্যের অভিযোগ ছাড়াও দেশটির বিভিন্ন কারাগার ও ডিটেনশন ক্যাম্পে হাজার হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ এসব ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেননি তিনি। শুধু মালয়েশিয়া হাইকমিশনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে তা কিন্তু নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দুবাইয়েও লাখ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক দূতাবাস ও কনসাল জেনারেল অফিসের অবহেলায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। কী পরিমাণ শ্রমিক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে বন্দী রয়েছেন সেই হিসাবও তারা জানেন না। আবুধাবী দূতাবাস ও দুবাই কনসাল জেনারেল অফিসে প্রতিদিন হাজারো শ্রমিক পাসপোর্ট ভিসা সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে হয়রানি হচ্ছেন। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মনিটরিং না থাকায় দেশটিতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার কারণে ওই দেশের সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। এখন শুধু বাংলাদেশীদের জন্য দেশটিতে সব ধরনের ভিসা ইস্যু বন্ধ রয়েছে (মহিলা ছাড়া)। একই অবস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাকে বাংলাদেশ দূতাবাসেও বিরাজ করছে। বিগত দিনে লেবার কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার অতিরিক্ত ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি ভিসা সত্যায়ন করার জন্য ওই কর্মকর্তার পিএকে টেবিল মানি দিতে হতো ১৫ হাজার টাকা। আর সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসেও একইভাবে প্রতিনিয়ত পাসপোর্ট রিনিউ থেকে শুরু করে নানা কাজে শ্রমিকদের হয়রানি পোহানোর অভিযোগ রয়েছে। এই দেশটিতে নতুন যে সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটি হচ্ছে এমআরপি পাসপোর্টে মূর্তির ছবি থাকা। ভুক্তভোগী শ্রমিকদের অভিযোগ দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ এই মূর্তিওয়ালা পাসপোর্ট দেখেই ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। এই সমস্যার কারণে অনেক শ্রমিককে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে বলে রিয়াদে বসবাসকারী একাধিক শ্রমিক জানান।
গতকাল মালয়েশিয়া থেকে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. শংকর চন্দ্র পোদ্দার নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনে আসা কর্মকর্তাদের খামখেয়ালি, অনিয়ম, দুর্নীতি আর জালিয়াতির কারণে আমাদের দেশের ভাবমর্যাদা ুণœ হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হাইকমিশন থেকে দুইবার পাসপোর্ট চুরি হলো কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের কারো শাস্তি হয়নি। যার কারণে কর্মকর্তারা মনে করছেন, চার বছরের জন্য এসেছি। এ সময়ের মধ্যে যা আখের গোছানো যায়। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না বলেই তারা এখানে এসে বেপোরোয়া হয়ে যান। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পাসপোর্ট চুরি, লাশ হস্তান্তরে অনিয়ম, ভিসা নবায়ন ছাড়াও পদে পদে হাইকমিশনে দুর্নীতি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ জন্য আমাদের সরকারের করণীয় হচ্ছে, এসব কর্মকর্তাদের প্রতি বছর পারফরম্যান্স যাচাই-বাছাই করে দেখা। যাদের পারফরম্যান্স খারাপ তাদের শাস্তি দেয়া আর যারা ভালো করবে তাদের পদোন্নতি দেয়া। এটি করা হলে বিদেশের মিশনগুলোতে হয়রানি, অনিয়ম আর দুর্নীতি-জালিয়াতি কমে আসবে।
এ ব্যাপারে গতকাল শুক্রবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়াসহ যেসব দেশে নতুন কাউন্সিলর ও শ্রমসচিব নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা রুটিন ওয়ার্ক। আগের যারা রয়েছেন তাদের চার বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। সেখানে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে।   

শেয়ার করুন