গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে বিএনপির মঞ্চে বিভিন্ন দলের নির্বাচনী আকাঙ্ক্ষা

0
124
Print Friendly, PDF & Email

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি দলের নেতারা অংশ নেনফাইল ছবি

নিত্যনতুন ইস্যুর বেড়াজালে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির মধ্যে এখনো কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবু দলগুলোর মধ্যে ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনকেন্দ্রিক পথচলার একটা নিজস্ব পথনকশা যে তৈরি হচ্ছে, সেটি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি আয়োজিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতার বক্তব্যে এর প্রকাশ ঘটে। অনেকের বক্তব্যে নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে থাকার অভিপ্রায় প্রকাশ পায়।

এখন পর্যন্ত সংস্কার ও নির্বাচন ঘিরে মুখ্য রাজনৈতিক দলগুলোতে যে তৎপরতা, তাতে একদিকে আছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো, অন্যদিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কিছু দলের ঐক্য প্রচেষ্টার একটি তৎপরতা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন মাঠে গড়ালে তখন বিএনপির বিপরীতে ইসলামপন্থী দলগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সে কারণে বিএনপির পাশাপাশি ইসলামপন্থী দলগুলোর তৎপরতার দিকেই অনেকে দৃষ্টি রাখছেন।

গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় ধরনের সমাবেশ করে আলোচনা তৈরি করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সেখানে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ (এনসিপি) সমমনা প্রায় সব ইসলামি দল অংশ নেয়। ওই সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি।

গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি আয়োজিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবচেয়ে কঠোর বক্তব্য দেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। তিনি কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘যারা নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে, নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চায়, দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সবাই টপ টু বটম, দেশপ্রেমিক জনতা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাই।’

এরপরেই মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘যিনি যত বড়, তাঁর দায়িত্ব এবং উদারতা প্রদর্শনের জায়গাটাও তত প্রশস্ত। অতএব এই জায়গাটাকে আমরা সবাই পরিচর্যা করার চেষ্টা করব।’

লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি এই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্ত ছিলেন। অনেকে মনে করছেন, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর এ বক্তব্য বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্দেশে, যা মনোনয়ন প্রত্যাশার প্রকাশ। আফেন্দী নীলফামারী-১ আসন (ডোমার-ডিমলা) থেকে নির্বাচন করতে চান। গত ঈদুল আজহায় এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি পোস্টারও লাগিয়েছেন।

বিএনপির অনুষ্ঠানে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে বক্তব্য দেন ইসলামি বক্তা জুনাইদ আল হাবিব। তিনি বলেন, ‘শেষ কথা বলতে চাই, চরম নির্যাতনের মুখেও মাঠে ছিলাম, এখন পর্যন্ত মাঠে আছি। আজকের যিনি উদ্বোধক, যিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; তিনি প্রবাসে থেকে যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিবাদের যেইভাবে পতন ঘটিয়েছেন; আজকে বলব—সেই পতনের যারা ফাটল ধরাবেন, তারা ফ্যাসিবাদের দালাল, তারা এ দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু।’

জুনাইদ আল হাবিব জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে নির্বাচন করতে চান।

প্রসঙ্গত, ইসলামি দলগুলোর ভোট ‘একটি বাক্সে’ পাঠাতে গত ২৪ এপ্রিল একমত হয়েছিল সমমনা পাঁচ ইসলামি দলের নেতারা। সেখানে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ঘিরে যে কী হতে যাচ্ছে, তা চলতি জুলাই বা আগামী আগস্টের মধ্যে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে কারা বিএনপির সঙ্গে, আর কারা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঐক্যে শামিল হবে, সেই মেরুকরণও দৃশ্যমান হবে। এখন পর্যন্ত ইসলামি দলগুলো কে কোন দিকে যাবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়। এ ক্ষেত্রে মাওলানা মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তসহ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কিছু ইসলামি দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

নির্বাচন ও সংস্কার ঘিরে বিএনপির বিপরীতে এখন পর্যন্ত যে তৎপরতা, তার কেন্দ্রে রয়েছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। বিএনপির জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির অনুষ্ঠানে জামায়াত অংশ নিলেও ইসলামী আন্দোলন যায়নি। ওই অনুষ্ঠানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বক্তব্য দেন। খুব সংক্ষেপ ও নিরুত্তাপ বক্তব্যে তিনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে জামায়াতের অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থে যেকোনো ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে শামিল থাকার দলীয় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

আবদুল হালিম বলেন, ‘আমরা সব সময় জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাসী। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা ২০ বছর ২০–দলীয় জোটে আন্দোলন করেছিলাম। ভবিষ্যতে জাতীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেকোনো ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে আমরা থাকব।’

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির অনুষ্ঠানে ৬০টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এতে ৫০টির মতো দল ও সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ২২টি দলের নেতা বক্তব্য দেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন ও মাওলানা মামুনুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তারা আসেনি।

অবশ্য ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তাঁরা বিএনপির আমন্ত্রণ পাননি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতা–কর্মীরা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতা–কর্মীরাফাইল ছবি

আর সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের (সিপিবি) প্রেসিডিয়ামের সভা ছিল। সে কারণে যেতে পারিনি। তা ছাড়া আমার নামে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিল, সে কারণে প্রতিনিধি পাঠানো যায়নি।’

গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির বিএনপির অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দলের নেতাদের বক্তব্যে নানা বিষয় প্রকাশ পায়। এর মধ্যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সবাই সমবেতভাবে কাজ করবে কি না, ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা সেই জনগণের স্বপ্ন পূরণ করবে কি না, দেশ আবার স্বৈরতান্ত্রিকতায় ফিরে যাবে কি না, সে প্রশ্নগুলোও এসেছে। এ ছাড়া গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নির্বাচনী ব্যালটে না রাখা, আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস না করা, নানা বাহানায় আওয়ামী লীগকে ফেরাতে বিভিন্ন মহলে প্রচেষ্টার সমালোচনা করেন অনেকে। এর মধ্যেও বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ সব নেতার বক্তব্যেই ঐক্যের কথাই বেশি এসেছে।

এই ঐক্যের জন্য প্রধান দল বিএনপিকে কী করতে হবে, সে পরামর্শও আসে আলোচকদের মধ্য থেকে। আওয়ামী লীগের সময় হয়রানি ও কারাবন্দী হয়েছিলেন লেখক ও চিকিৎসক সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্ত। তিনি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্দেশে বলেন, ‘একটা অনুরোধ রেখে যাই, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশকে বাঁচাতে ঐক্যের বিকল্প নেই। বিএনপি এই মুহূর্তে আন প্যারালাল একটি বড় দল। বড় দলের দায়িত্ব বেশি। ছোট দলগুলো যাতে আস্থার সংকটে না ভোগে, একটি ছাতা হয়ে বিএনপি যেন সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যায়।’

জুলাই শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য এবং বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের অংশগ্রহণে এই অনুষ্ঠান ছিল ভিন্ন রকম। তাঁদের বক্তব্যে অনেক ক্ষোভ, আক্ষেপ ও নানা অভিযোগ উঠে এলেও সবাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করেছেন। এটাকে গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতি অনুষ্ঠানের মূল দিক বলে মনে করেন বিএনপির ‘জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূতি পালন’ ব্যবস্থাপনা উপকমিটির আহ্বায়ক ও দলের যুগ্ম মহাসচিব শহীদউদ্দীন চৌধুরী।

শহীদউদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অনেকের বক্তব্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ প্রকাশ পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতের ভিন্নতা, প্রতিযোগিতা আছে, থাকবে। তবে ফ্যাসিস্টের ব্যাপারে সবাই ঐক্যবদ্ধ, সেটাই সবাই জানান দিয়েছে।

শেয়ার করুন