রুপসীবাংলা, চট্টগ্রাম (২৫ নভৈম্বর): নগরীর বহদ্দারহাটের অদূরে খাজা রোডে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ৩টি গার্ডার ভেঙে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনায় রোববার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পুনরায় উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ জনে। স্থানীয় চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল বণিক এ সংবাদের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেনাবাহিনীর কর্নেল নাইম আশফাক চৌধুরী জানান, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে উদ্ধারকাজ চলছে। এতে সহযোগিতা করছে নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস, র্যাব ও পুলিশ।
উদ্ধারকাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ঢাকা থেকে সরঞ্জাম আনা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ভাইব্রেটিং ড্রিল মেশিন, গ্যাস কাটার, গ্যাসের সিলিং, এয়ার কমপ্রেশার মেশিনসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বেলা ১১টার দিকে পৌঁছাবে বলে আশা করছি।’’
গার্ডারের ওজন বেশি হওয়ায় টেনে বের করা যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা ১০০ টনেরও বেশি ওজনের গার্ডারগুলোকে ছোট ছোট টুকরা করে অপসারণের চেষ্টা করছি।’’
এভাবে কাজটি শেষ হতে ২ দিনের মতো সময় লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
শনিবার সন্ধ্যায় ভেঙে পড়ে ৩টি গার্ডার
এর আগে প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন নিহতের সংখ্যা ৫ দাবি করলেও জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান ৩ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা ফ্লাইওভারের নির্মাণসামগ্রী ও সরঞ্জামে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে গোটা বহদ্দারহাট এলাকায় পুলিশ-জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অনেককে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ আশপাশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফ্লাইওভারের নিচে প্রতিদিনের মতো সবজি বিক্রেতারা পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। দুর্ঘটনায় এসব সবজি বিক্রেতারা হতাহত হন।ঘটনাস্থলেই ৫ জন মারা গেছেন বলে স্থানীয়রা জানান।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম তানভীর আরাফাত প্রাথমিকভাবে ২ জনের মৃত্যুর বিষয়টি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেন।হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানান তিনিও।
এদিকে ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে বহু লোক হতাহত হয়েছে মর্মে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। একপর্যায়ে উত্তেজিত জনতা ফ্লাইওভার-নির্মাণশ্রমিকদের থাকার জন্য অস্থায়ীভাবে তৈরি করা ছাউনিতে আগুন ধরিয়ে দেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বহদ্দারহাট থেকে উত্তেজনা নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।জিইসি মোড় থেকে চকবাজার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে মিছিল বিক্ষোভ দেখা যায়।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বেশ কয়েকটি গাড়ি। ঘটনার পর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান জানান, উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এর কিছু সময় পরেই সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দেয়।
ধ্বংসস্তূপের নিচে জোড়া পা:
ভেঙে পড়া গার্ডারের নিচে এখনো দেখা যাচ্ছে জোড়া পা, মানুষের শরীরের উপরের অংশ। ফ্লাইওভারের নিচে জমে থাকা পানি আর রক্ত একাকার হয়ে আছে। বীভৎস এ দৃশ্য উপেক্ষা করে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে দানবাকৃতির গার্ডারের নিচে চাপা পড়া নিথর দেহগুলো উদ্ধারের জন্য।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য:
ফ্লাইওভার সংলগ্ন শাহ আমানত ডেকোরেটর্সের মালিক হাজি মো. বখতেয়ার, কর্মচারী আলমগীর ও সৈয়দ মঈনুদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমরা হঠাৎ করে বিকট আওয়াজ শুনতে পাই। প্রথমে একটি গার্ডার ভেঙে পড়ে। এরপর আরো দুটি। এসময় পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তারা জানান, এসময় বহদ্দার পুকুর পাড়ে কিছু লোক ও পথচারী গল্পগুজব করছিলেন, কয়েকজন সবজি বিক্রেতা ছিলেন। সব মিলে ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষ ছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা:
বিক্ষুব্ধ জনতা নির্মাণশ্রমিকদের থাকার জন্য অস্থায়ী ভাবে তৈরি করা ছাউনি, ফ্লাইওভারের নিচে রাখা নির্মাণসামগ্রীতে আগুন ধরিয়ে দিলে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি আসে। উত্তেজিত জনতা ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকলে গাড়িটি ফিরে যায়।
পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ
বহদ্দারহাট মোড়ে উত্তেজিত জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা ৫টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে ১টি মোটরসাইকেল সাংবাদিকের বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (ৠাব) একটি টিম।
এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চলছে নিহতের স্বজনদের আহাজারি। ইতিমধ্যে মো. মামুন (৩০), মো. রাসেল (২৬), ওমর ফারুক (৩৩), হাফিজুল মিয়া (১৬), সোহেল মিয়া (৩০), শাহাবুদ্দিন (২০), নাজমা আকতার (২৬), রিপন ধর (২৬)সহ অজ্ঞাত পরিচয়ের ৩জনকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের জরুরি বিভাগ ছাড়াও ক্যাজুয়ালিটি, ২৬ ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের গাড়িতেও হামলা:
উত্তেজিত জনতা চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) গাড়িতে হামলা করেছে। তবে তারা অক্ষত রয়েছেন। এ ছাড়া একটি অ্যাম্বুল্যান্স ও ১২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে বহদ্দারহাট এলাকায় দফায় দফায় কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে।
জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
ফুঁসে উঠেছে জনতা, সিডিএ চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি:
ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে নগরীর বড় একটি অংশের মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছিলেন। রোদ-বৃষ্টিতে কাদা-পানি, যানজট আর ধুলোঝড়ে কাহিল অবস্থা তাদের। নির্মাণকাজে ধীরগতি, আরাকান সড়কের বেহাল দশায় অতিষ্ঠ যাত্রী ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ ইতিমধ্যে সড়কের কাদাপানিতে ধানের চারা রোপণ ও কই মাছ ছেড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ও এলাকাবাসী গার্ডার ভাঙার পরপরই রাস্তায় নেমে আসে। তারা সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের পদত্যাগ দাবিসহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে এ ফ্লাইওভারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি এ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
উদ্ধারকাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী:
ভেঙে পড়া ফ্লাইওভারের গার্ডারের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনীর একটি টিম। রাত পৌনে ১০টার দিকে তারা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। এরপর দ্রুত কাজ শুরু করে। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উত্তেজিত জনতাকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে।
ঘটনার মোড় অন্য দিকে নেওয়ার চেষ্টা:
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের জানান, ফ্লাইওভারের এ দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে উত্তেজিত জনতার আড়ালে একটি মহল উস্কানি দিচ্ছে বলে ধারণা করছি। তারা ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুল্যান্স, সাংবাদিকদের মোটরসাইকেলে আগুন, আমাদের গাড়িতে হামলাসহ ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর চেষ্টা করছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।
শাস্তি দাবি করলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী
নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ‘অযোগ্য অথর্ব লোক দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ করায় বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ফ্লাইওভার নির্মাণে সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, ঠিকাদারসহ দোষী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং হতাহত ব্যক্তিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি জানান।
এদিকে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন ও মেয়র এম মনজুর আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং আহতদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখতে যান।
এ ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম বিএসসি এক বিবৃতিতে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
আবদুল্লাহ আল নোমানের নিন্দা
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান এক বিবৃতিতে বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে প্রাণহানি ও আহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এ ছাড়া সম্প্রতি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম চট্টগ্রাম সফরকালে ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কিন্তু তারপরেও সিডিএ এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
নোমান বলেন, ফ্লাইওভার দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা সরকারের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ। একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কীভাবে কার্যাদেশ পেল এবং তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে কি না তা জনসম্মুখে প্রকাশের পাশাপাশি দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সিডিএ চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন ‘ওয়েল ফুড’ ভাঙচুর
উত্তেজিত জনতা রাত ১০টার দিকে বহদ্দারহাট মোড়ে সিডিএ চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন ‘ওয়েল ফুড’র প্রদর্শনকেন্দ্র ভাঙচুর করেছে। এসময় তারা বহদ্দারহাট পুলিশ বিটে হামলা চালায়।
এদিকে, ঘটনাস্থলের পাশে বহদ্দার বাড়ি জামে মসজিদ কবরস্থানের সীমানা প্রাচীর ভেঙে আহত হয়েছেন অন্তত ১২ জন। তারা ওই দেয়ালে উঠে উদ্ধারকাজ দেখছিলেন। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
উল্লেখ্য, সিডিএর নির্মাণাধীন এ ফ্লাইওভারে এবারসহ তিনবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ ফ্লাইওভার নির্মাণের কার্যাদেশ পায়। তবে প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা কাজটি না করে জেবি কনস্ট্রাকশনসহ অন্য ২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ফ্লাইওভার নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছে।
নিউজরুম