শেখ হাসিনার স্থলে যদি আপনি হতেন!

0
477
Print Friendly, PDF & Email

বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে যারা সমালোচনা করতে চান কিংবা ভালোবেসে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে চান তাদের উচিত সবার আগে তার জীবনের কিছু নির্মম ঘটনা, রূঢ় বাস্তবতা এবং কঠিন সময়ের কিছু ইতিকথা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেওয়া। কারণ ‘আমাদের সমাজের প্রায় সবাই সেই অনাদিকাল থেকেই কাউকে অপছন্দ করি, কারও সমালোচনা করি তার সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই।’ মানুষের অভ্যাস ও সাধারণ ভ্রান্তি সম্পর্কে উল্লিখিত বক্তব্যটি বলে গেছেন মহাজ্ঞানী হজরত আলী (রা.)। এবার আমি মানুষের ভালোবাসা সম্পর্কে কিছু বলে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে চলে যাব। আমরা সাধারণত আবেগের বশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাউকে ভালোবাসি এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা করি। ফলে সামান্য অস্থিরতা কিংবা সময়ের উলট-পালট আমাদের আবেগময় ভালোবাসা কর্পূরের মতো উড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভালোবাসা উল্টো বিরাগে পরিণত হয় এবং ভক্তির জায়গায় অভক্তি ও শ্রদ্ধার স্থলে অশ্রদ্ধা এসে পড়ে। এ কারণে সব ধর্মমত, জ্ঞানী-গুণী-বিজ্ঞানী এবং সাধু-সজ্জনরা জেনে-শুনে, বুঝে-সুজে এবং ধীরে-সুস্থে ভালোবেসে ভক্তি-শ্রদ্ধা করার উপদেশ দিয়েছেন।

আজকের নিবন্ধের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে তেমন কিছুই বলব না। আমি শুধু সম্মানিত পাঠকদের উদ্দেশে কতগুলো প্রশ্ন রাখব। ধরুন আপনি এমন একজন মানুষের সন্তান, যাকে কিনা আপনি মানব থেকে মহামানবে পরিণত হওয়ার এবং সাধারণ মানুষ থেকে মহানায়কে রূপান্তরিত হওয়ার জীবনযুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করতে দেখেছেন। অন্তর দিয়ে আপনি আপনার পিতাকে সমর্থন করেছেন এবং নিজের তথা পরিবারের সীমাহীন দুর্ভোগ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ ইত্যাদিকে পায়ের নিচে রেখে পিতাকে বড় হওয়ার জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনার পরিবারের সবার আত্মত্যাগ, সমন্বিত সমর্থন ও সহযোগিতায় আপনার পিতা সত্যিই একদিন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছলেন। তারপর কোনো একদিন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সঙ্গে আপনার মা, ভাই, ভাবীসহ অন্যান্য আপনজনকেও একই নির্মমতায় হত্যা করার পর হত্যাকারীরা এমন দম্ভের তাণ্ডব শুরু করল যে, আপনার প্রিয় মাতৃভূমিতে আপনার জন্য এক ইঞ্চি জায়গাও বসবাস-উপযোগী বা নিরাপদ রইল না।

আপনি আপনার রক্তাক্ত বেদনাময় স্মৃতি, ভগ্ন ও আশাহত হৃদয় এবং সবকিছু হারিয়ে হঠাৎ করে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে যাওয়া দুরবস্থাকে সম্বল করে শিশুসন্তানসহ নিদারুণ এক পরবাসী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হলেন। সময়ের প্রয়োজনে কয়েক বছর পর আপনি যখন সাধারণ মানুষের টানে, দেশের মায়ায় দেশের প্রয়োজনে মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন তখন নির্মম কিছু ঘটনা আপনাকে পুনরায় নতুনভাবে ক্ষত-বিক্ষত করতে আরম্ভ করল। আপনার পৈতৃক বাড়িটিতে আপনাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না, দেশের কোথাও আপনি নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারলেন না। অনেক দিন পর্যন্ত আপনি চেষ্টা করেও একটি বাসা ভাড়া করতে পারলেন না। আপনার পরিচিত নগরী অপরিচিত হয়ে উঠল। মহলবিশেষের কারণে যেমন নিজ বাড়িতে উঠতে পারলেন না তেমনি একই মহলের রক্তচক্ষুর কারণে ঢাকা মহানগরীর কেউ আপনাকে বাসা ভাড়া দিতে সাহস পেল না। আপনার দুর্বিষহ ও দুঃস্বপ্নের সেই দিনগুলোতে আপনি আপনার চারদিকে কেবল ষড়যন্ত্র এবং শত-সহস্র নতুন আততায়ীর পিলে চমকানো অট্টহাসি, দাপাদাপি ও হুঙ্কার শুনতে থাকলেন— জনমতের প্রচণ্ড চাপ এবং দেশি-বিদেশি সুধীজনের সমালোচনার কারণে আপনি একসময় পৈতৃক বাড়িটিতে বসবাসের অনুমতি গেলেন বটে কিন্তু সেই বাড়িতে আপনি যেন না থাকতে পারেন সেজন্য আপনার শত্রুরা বহুমুখী চক্রান্তের জাল আপনার চারদিকে ছড়িয়ে দিল। তারা প্রথমে আপনজন বলে দৃশ্যমান কিছু লোক যারা আপনাকে সাদরে বিদেশ থেকে বহু অনুরোধে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের আপনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। তারা চাইল, আপনি হয়তো তথাকথিত আপনজন ভাই-ব্রাদার, মামা-চাচাদের প্রতারণায় বিক্ষুব্ধ হয়ে দেশত্যাগ করবেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। ফলে আপনার শত্রুরা আপনাকে দুর্বল করার জন্য দুই দফায় আপনার দলটি ভাঙার চেষ্টা করে। প্রথম দফায় দলের কতিপয় শীর্ষ নেতা তৎকালীন আপনার অনুগত ছাত্র সংগঠনটির সবচেয়ে মেধাবী ও লড়াকু অংশকে বাগিয়ে নিয়ে ভিন্ন দল গঠন করেন। দ্বিতীয় দফায় আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতা হুবহু একই কাণ্ড করেন প্রথম ঘটনার প্রায় বছর দশেক পর।

রাজনৈতিকভাবে আপনাকে মেরে ফেলার চক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে সরেজমিন আপনাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য আপনার শত্রুরা করেনি এহেন কুকর্ম নেই। আপনার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শত্রুদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো শত্রুর পতনের পর নতুন শত্রুর আবির্ভাব ঘটেছে। আপনি হয়তো আশায় বুক বেঁধেছেন যে, নতুনরা হয়তো পুরনোদের মতো জঘন্য হবে না। কিন্তু আপনাকে অতীব আশ্চর্যান্বিত করে দিয়ে নতুন শত্রুরা হুবহু পুরনোদের অনুসরণ তো করেছেই— অধিকন্তু কেউ কেউ অতীতের চেয়েও বেশি নির্মমতা ও পাশবিকতা নিয়ে আপনাকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তারা আপনার পিতা-মাতার হত্যাকারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের মধ্যে একদল ওইসব হত্যাকারীকে ডেকে এনে তাদের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আপনাকে প্রথমে প্রাণনাশের উপর্যুপরি হুমকি-ধামকি এবং একসময় সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে আপনার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে।

মহান সৃষ্টিকর্তার অপার দয়ায় আপনি চিহ্নিত এবং আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের আক্রমণ থেকে বার বার রক্ষা পেয়ে গেছেন। আপনার শত্রুরা এর পরও থেমে থাকেনি। তারা আপনাকে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ, অসুস্থ ও বিধ্বস্ত করে দেওয়ার জন্য সেসব হত্যাকারীকে রাষ্ট্রীয় পদ, সাংবিধানিক পদ, প্রচারযন্ত্র, প্রচারমাধ্যমের মালিকানা এবং অঢেল অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সজ্জিত করে আপনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। হত্যাকারী দুর্বৃত্তরা রাষ্ট্রীয় মদদে বলীয়ান হয়ে জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে আপনাকে ক্রমাগত আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত করতে গিয়ে প্রকৃতির রুদ্ররোষে একসময় নিজেরাই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যায়। আপনার শত্রুরা আত্মস্বীকৃত ও চিহ্নিত হত্যাকারীদের আপনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বহু আততায়ী, মীরজাফর, জগেশঠ, ব্রুটাস এবং বিভীষণ জাতীয় অমানুষদের নিয়োগ করে আপনাকে ছলেবলে-কৌশলে ধরাধাম থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য অথবা সেটা ব্যর্থ হলে নিদেনপক্ষে পঙ্গু, অকর্মণ্য, ক্ষমতাহীন, নির্জীব একজন অসহায় সৃষ্টিতে পরিণত করার জন্য।

শত্রুদের পরিকল্পনা ও মদদে আততায়ীরা বহুবার আপনার ওপর নজিরবিহীন প্রকাশ্য আক্রমণ চালায়। তারা আপনার শত শত নেতা-কর্মী অনুগত শুভানুধ্যায়ীকে গুলি করে, ব্রাশফায়ার করে, বোমা মেরে, চাকু মেরে অথবা পিটিয়ে মেরে ফেলে। তারা আপনার হাজার হাজার অনুগত নেতা-কর্মীকে মারধর, জখম এবং সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করার পাশাপাশি জেল-জুলুম, হুলিয়া ও নির্বাসনের মাধ্যমে মূলত আপনাকে শেষ করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা তৃতীয় দফায় আপনার বহুদিনের বিশ্বস্ত, পরিচিত, আপনজন এবং আপনার নিজ হাতে গড়া বিপুল শ্রেণির শীর্ষ নেতাকে টোপ দিয়ে বেইমান, অবাধ্য ও নিমকহারামে রূপান্তরিত করে আপনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। আপনাকে জেলে ঢুকিয়ে আপনার এককালের অনুগত ও বিশ্বস্ত বলে পরিচিতি পাওয়া নিমকহারামদের দ্বারা আপনার শত্রুরা সেই কাজটি করানোর চেষ্টা করে যেমনটি করেছিল কুখ্যাত রবার্ট ক্লাইভ তার পোষা কুকুর মীরজাফর-পুত্র মিরনের দ্বারা।

জীবনের শেষ প্রান্তে জেলখানায় ঢুকে আপনি বহু বছর পর একান্তে নিজেকে আবিষ্কারের সুযোগ পেলেন। হিসাব করে দেখলেন, জীবনের ষাটটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ২৬ বছরের সংগ্রামী এবং বেদনাবিধুর রাজনৈতিক জীবন, ২৮ বছরের ব্যক্তিগত জীবন এবং ছয় বছরের প্রবাস জীবনের হিসাবের খাতা মেলাতে গিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। জীবনের কোনোকালে এক নাগাড়ে একটি মাস শান্তিতে কাটিয়ে ছিলেন কিনা তা কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিলেন না। জেলে বসে চলমান রাজনৈতিক প্রহসন, অতীতের গ্লানি, বেদনা, বহুমুখী চক্রান্ত ইত্যাদি স্মরণ করে আপনি বার বার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে থাকলেন নিবিড়ভাবে। আপনি অতীতের মতো কখনো আশাহত হলেন না বটে কিন্তু আশাবাদী হওয়ার মতো উপলক্ষও খুঁজে পেলেন না। একেকটি দিন আপনার কাছে বছরের মতো লম্বা এবং যন্ত্রণাদায়ক বলে মনে হতে লাগল। এরই মধ্যে বিধাতা হয়তো আপনার প্রতি দয়াপরবশ হলেন। পুরো পরিস্থিতি অলৌকিকভাবে আপনার অনুকূলে চলে এলো। আপনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন এবং কিছুদিন পর রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর প্রধান নির্বাহীর পদে অধিষ্ঠিত হলেন। ৬২ বছর বয়সে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে আপনি প্রথমেই সর্বান্তকরণে আপনার সৃষ্টিকর্তার কাছে সর্বাত্মক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আপন কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। আপনার দীর্ঘদিনের সংকল্প, নীতি-আদর্শ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগে গেলেন। পুরো পরিস্থিতি এবং সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। এ অবস্থায় আপনার পিতা-মাতা পরিবার-পরিজনের হত্যাকারীদের বিচার করা, প্রতিশোধ নেওয়া, নির্মূল করা অথবা ক্ষমা করার একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং সুযোগ দুটোই আপনার কর্তৃত্বে চলে এলো। আপনার শত্রু, আপনাকে হত্যা চেষ্টাকারী দুর্বৃত্ত, আততায়ী, বেইমান, মোনাফিক, নাফরমান, অকৃতজ্ঞ দুরাচার সম্প্রদায় রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে কেউ আত্মসমর্পণ করল, কেউ রং পাল্টিয়ে মিত্র সাজার চেষ্টা করল, অনেকে জনারণ্যে মিশে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাল এবং কেউ কেউ পালাল।

ক্ষমতার মসনদে বসে আপনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, দুরাচার জগেশঠের বশংবদরা নবরূপে আপনার সামনে ভিড় করেছে। তারা এমন বেশে এমন রূপে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, আপনি সবকিছু বোঝা সত্ত্বেও সবাইকে পরিহার করতে পারলেন না। মীরজাফর, মিরন ও খন্দকার মোশতাকরা ভণ্ডামির নতুন পোশাক পরিধান করে, প্রতারণার লাল টুপি মাথায় দিয়ে এবং চাটুকারিতার বিস্ময়কর সব সংলাপ মুখস্থ করে আপনার সামনে এসে এমন নাচন-কুদন এবং আবৃত্তি শুরু করে দিল যা দেখে আপনি বার বার আপন মনে বিতাড়িত ও অভিশপ্ত শয়তান থেকে পানাহ চেয়ে যেমন আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতে থাকলেন তেমনি মানুষরূপী খান্নাসদের অনিষ্ট, জাদু-টোনা ও বাণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর শেখানো প্রার্থনা সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করতে করতে ক্ষমতার মসনদে উত্তরোত্তর অধিক ক্ষমতাবান হয়ে দশটি বছর অতিক্রান্ত করলেন।

আপনার সম্পর্কে আমি আজ আর কথা বাড়াব না। আমি শুধু উল্লিখিত কাহিনীর আলোকে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই যে, আপনি যদি নিবন্ধে বর্ণিত ঘটনা-দুর্ঘটনা, চক্রান্ত, আক্রমণ ইত্যাদির ভুক্তভোগী হন তাহলে আপনার সুসময়ে আপনি আপনার প্রতিপক্ষ, শত্রু-মিত্র, আততায়ী এবং ভাড়াটে খুনিদের বাগে পেয়ে তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবেন? প্রশ্নটির সঠিক জবাব দেওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই সত্যিকার ভুক্তভোগী হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সমপর্যায়ভুক্ত হতে হবে— তা না হলে আপনার জবাব আবেগ-রাগ-অনুরাগ, অতিমানব সাজার ব্যর্থ চেষ্টা, সত্যের অপলাপ, মিথ্যাশ্রয়, লোক দেখানো, ভণ্ডামি ইত্যাদি দোষে দুষ্ট হতে পারে। কাজেই আপনি যেহেতু বঙ্গবন্ধুকন্যা নন কিংবা আওয়ামী লীগ নামক বৃহত্তম দল পরিচালনা করার সাঁইত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা অথবা তিন মেয়াদে সতেরো কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত পৃথিবীর সর্বকালের ঘনবসতিপূর্ণ দারিদ্র্যপীড়িত এবং সমস্যাসংকুল একটি দেশকে পনেরো বছর শাসন করার অভিজ্ঞতা যেহেতু আপনার নেই, সেহেতু উল্লিখিত ঘটনার আলোকে আপনার প্রতিক্রিয়া জিজ্ঞাসা না করে আপনার অবস্থান অনুযায়ী কিছু প্রশ্ন করি— ধরুন আপনি মহল্লার একজন সম্মানিত মুরব্বি। একদিন দেখলেন পাড়ার একটি ছেলে আপনাকে লক্ষ্য করে পায়ের ওপর পা তুলে ধুমছে সিগারেট টানছে এবং আপনার প্রিয় কন্যাটি সম্পর্কে অশ্লীল মন্তব্য করছে। এ অবস্থায় আপনি হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী নয়, কেবল এক দিনের জন্য আপনার থানার ওসি হলে কী করতেন? আরেকটি উদাহরণ দিই। ধরুন নতুন বিয়ে করে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে ঢাকা শহরে নতুন বাসা ভাড়া নিয়েছেন। মহল্লার টাউট কদম আলী রোজ আপনার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে নানা কটূক্তি করে, শিস বাজায় এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে। কদম আলীকে শাস্তি দেওয়া কিংবা প্রতিরোধ করার কোনো সামর্থ্য আপনার নেই। এ অবস্থায় এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন, আপনি র‌্যাবের কমান্ডার হয়ে গেছেন এবং কদম আলীকে গ্রেফতার করে আপনার সামনে আনা হয়েছে। এ অবস্থায় আপনি কি কদম আলীকে কদমবুচি করবেন নাকি তাকে লক্ষ্য করে শিস বাজাবেন? উল্লিখিত দুটি উদাহরণের মতো আরও শত-সহস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে আপনি আপনার সঙ্গে কৃত অসদাচরণ, কটূক্তি কিংবা ফৌজদারি অপরাধের জন্য আপনার প্রতিপক্ষ কিংবা শত্রুর গায়ের চামড়া খুলে জুতা বানানো, তার ৩২টি দাঁত একটি চড় মেরে ফেলে দেওয়ার সংকল্প অথবা তাকে বিষযুক্ত ধারালো টেঁটা-বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার স্বপ্নে বিভোর রয়েছেন।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এবার আল্লাহর ওয়াস্তে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন ভুক্তভোগী হিসেবে অপরাধী শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী, আশপাশের মোনাফিক ও মীরজাফরদের সঙ্গে জননেত্রী শেখ হাসিনার আচরণ কি তেমন যেমনটি আপনি আপনার শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী, পারিপার্শ্বিক মোনাফিক, মীরজাফরদের সঙ্গে করেন কিংবা করতে চান। আপনার দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী যদি আপনার সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে থাকেন তবে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। আর তিনি যদি কর্মে, চিন্তা-চেতনা ও প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার চেয়ে উদার, ধৈর্যশীল, যৌক্তিক এবং বিবেকসম্পন্ন আচরণ করে থাকেন তবে তাকে সম্মান করুন— কারণ এটি তার প্রাপ্য। যা না প্রদর্শন করলে আপনি গুনাহগার হবেন। অন্যদিকে, আপনার যদি সত্যিই মনে হয়, তিনি আপনার চেয়ে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও নির্মম তাহলে আপনার সাধ-সাধ্য অনুযায়ী তার সমালোচনা করুন এবং সম্ভব হলে তার বিরোধিতা করে আপনার হক আদায় করুন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন