১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে রায়েরবাজারের রুদ্রপাল সম্প্রদায়ের গোপাল হরিপাল এবং সুরবালা পালের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের শ্রেষ্ঠ কারিগর ‘মৃৎরাজ মরণ চাঁদ পাল’। বাংলাদেশের শিল্পকলার প্রাণপুরুষ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ঢাকায় শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীসমাজ সৃষ্টিতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন অনেক আগে থেকেই। তাঁর স্বপ্নের পরিপূর্ণতার জন্য তিনি অন্বেষণ করে ফিরছিলেন অহর্নিশ। তিনি উপলব্ধি করেন বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে এ দেশের কারুশিল্প। এ কারণে চারুশিল্পের পাশাপাশি তিনি কারুশিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেন এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে শিল্পাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রায়েরবাজার পাল সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়া সবে কৈশোরে পা দেওয়া ‘লক্ষ্মী নারায়ণ পাল’, যিনি অতি অল্প বয়সে অবলীলায় হুইল থ্রোইংয়ের মাধ্যমে তৈরি করে চলেছেন বিভিন্ন ব্যবহারিক মৃৎপাত্র। তাঁর দক্ষতা ও প্রতিভা শিল্পাচার্যকে অভিভূত করতে সক্ষম হয়। শিল্পাচার্য সিদ্ধান্ত নেন এই কিশোরকে তিনি তাঁর শিল্প আন্দোলনের সহযোদ্ধা রূপে গ্রহণ করবেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালে চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মৃৎশিল্প বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়।
শিল্পী মীর মোস্তফা আলী এই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিল্পী মীর মোস্তফা আলী এবং জাপানি মৃৎশিল্পী কোইচি তাকিতার তত্ত্বাবধানে এই বিভাগে প্রথম ব্যাচে পাঁচজন ছাত্র নিয়ে ক্লাস শুরু করেন। প্রথম ব্যাচের এই পাঁচজন ছাত্রের চারজনই চারুকলা ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে ডিগ্রি অর্জন করা ছিলেন। শুধু লক্ষ্মী নারায়ণ পাল ছিলেন ঐতিহ্যবাহী পাল সম্প্রদায় থেকে আসা, যার চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পূর্ণ ছিল না। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বিশেষ বিবেচনায় তাঁকে এই বিভাগে ভর্তি করেছিলেন। পারিবারিক শিক্ষার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আধুনিক মৃৎশিল্পের মিশ্রণে এই শিল্পী হয়ে ওঠেন আরও বেশি সচেতন এবং তাঁর তৈরি মৃৎশিল্প পায় ভিন্ন মাত্রা। সার্টিফিকেট কোর্সে তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এবং ১৯৬৩ সালে বিভাগীয় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ভর্তির সময় লক্ষ্মী নারায়ণ পাল নাম থাকলেও পরবর্তী সময়ে তিনি ‘মরণ চাঁদ পাল’ হিসেবে পরিচিতি পান। উল্লেখ্য, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে শিল্পচার্য তাঁকে মরণ চাঁদ পাল নামে ডাকতেন এবং এই নামেই তিনি প্রতিষ্ঠিত হন।মৃৎশিল্পের ইউরোপীয় ধারা এবং নিজের ঐতিহ্যের ধারাকে সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি দেশ-বিদেশের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে ভারতের সরকারি পটারি উন্নয়ন কেন্দ্রে মৃৎশিল্পের ওপর কোর্স সম্পন্ন করেন।তিনি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে মৃৎশিল্পের ওপর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন থেকে শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসেবে পুরস্কৃত হন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত তিনি কারিকা বাংলাদেশ হস্তশিল্প সমবায় ফেডারেশন লিমিটেডের পরিচালকের দায়িত্ব এবং ১৯৭৬-১৯৭৭ পর্যন্ত সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে এশিয়ান রিজিওনাল আর্টিশিয়ান ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে ‘মাস্টার ক্রাফটসম্যান’ সার্টিফিকেট লাভ করেন।
২০০০ সালে কারিকা বাংলাদেশ হস্তশিল্প সমবায় ফেডারেশন লিমিটেড কর্তৃক মাস্টার ক্রাফটসম্যান মৃৎশিল্পী হিসেবে আজীবন শিল্পকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানপত্র গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে তিনি জাতীয় কারুশিল্পী পরিষদ থেকে মৃৎশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ‘শিলু আবেদ পুরস্কার’ লাভ করেন।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে শিল্পী মরণ চাঁদ পালের নামে বিশেষ কর্নার রেখে তাঁর শিল্পকর্ম সংগৃহীত রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর শিল্পকর্ম রপ্তানি এবং সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে তাঁর শিল্পকর্ম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরকালে শিল্পীর তৈরি ‘মা ও শিশু’ টেপা পুতুল উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বর্তমানে হোয়াইট হাউসে সংগৃহীত রয়েছে। ফোকলোর প্রফেসর হেনরি গ্লাসি তাঁর আর্ট অ্যান্ড লাইফ ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে শিল্পী মরণ চাঁদ পালের জীবন এবং শিল্পকর্মকে স্থান দিয়েছেন, যে গ্রন্থটি ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
মহান এই শিল্পী আমৃত্যু শিল্পচর্চার বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে।বাংলাদেশের প্রায় হারিয়ে যাওয়া টেপা পুতুলকে নিজস্ব শিল্পশৈলীর সংমিশ্রণে উত্থিত করেছেন অনন্য এক উচ্চমার্গে। তাঁর দক্ষতা এবং নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছে মা ও শিশু, হাতি, ঘোড়া ইতাদি শিল্পকর্ম।তাঁর সৃষ্টি ‘বাকুড়া ঘোড়া’ খ্যাত ভাস্কর্য দেখলে সহজেই অনুধাবন করা যায়, তিনি মূল ফর্ম বাকুড়া থেকে গ্রহণ করলেও নিজস্ব চিন্তা, শিল্পচেতনা সংযোজনের মাধ্যমে সেটি পরিণত করেছেন তাঁর একান্ত নিজস্ব শিল্পকর্ম হিসেবে।প্রতিনিয়ত তিনি ফর্ম ভেঙে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।ঐতিহ্যবাহী টেপা পুতুলকে স্বতন্ত্র ভাস্কর্যে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছেন।তাঁর সহজ-সরল প্রকাশভঙ্গি এবং দেশীয় চেতনায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে তিনি পরিণত হয়েছেন মৃৎরাজে। শিক্ষক হিসেবে মরণ চাঁদ পাল নিজস্ব ভাবমূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। মৃৎশিল্প বিভাগকে তিনি আগলে রেখেছিলেন সন্তানের মতো। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত সব শিল্পীর হাতেখড়ি এই মহান শিক্ষকেরই কাছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে সহজ-সরলভাবে মিশে যাওয়ার গুণাবলির কারণে তিনি পরিণত হয়েছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষকে। বিভাগের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী—সবার চাহিদা, অভিযোগ এবং নির্ভরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সদাহাস্য এবং মিষ্টভাষী হওয়ার কারণে শুধু বিভাগেই নয়, বরং চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্বে। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন জাদুকর সমতুল্য। চোখের পলকে অনায়াসে কথা বলতে বলতে এক হাতের সাহায্যে হুইল থ্রোইংয়ের মাধ্যমে একটি পটারি তৈরি করতে দেখা ছিল সবার কাছে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। কখনো হাতের আঙুলের সাহায্যে টিপে টিপে তৈরি করে ফেলতেন তাঁর বিখ্যাত টেপা পুতুল। মৃৎশিল্পের করণকৌশল কিংবা পোড়ানোর পদ্ধতি যেকোনো বিষয়ে সমস্যার সমাধান তিনি দিতেন অনায়াসে। এককথায় তিনি ছিলেন মৃৎশিল্পের একজন জীবন্ত অভিধান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত শিল্পকর্ম তৈরি অথবা বাণিজ্যিকভাবে কাজ করার জন্য তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে আন্তরিক সহযোগিতা। প্রস্তুতকৃত কাদামাটি এবং শিল্পকর্ম পোড়ানোর জন্য যাবতীয় সুবিধা প্রদান করে তিনি মৃৎশিল্পচর্চায় আগ্রহীদের সব সময় ইতিবাচক সমাধান দিয়ে গেছেন। তিনি নিজ গৃহে স্থাপিত স্টুডিওতে গবেষণামূলক কাজের পাশাপাশি স্থানীয় যুবক ও যুব মহিলাদের মৃৎশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পাল পরিবারের পাশাপাশি বহু মুসলমান পরিবারের সদস্যগণ তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শিল্পচর্চা এবং সচ্ছলভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টেরাকোটা শিল্প ব্যতীত সমকালীন টেরাকোটা মাধ্যমে দেয়াল চিত্র নির্মাণের অধিকাংশ কাজের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশন, আমেরিকান দূতাবাস, ব্রিটিশ দূতাবাস, বাংলাদেশ ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইত্তেফাক ভবন উল্লেখযোগ্য। দুঃখজনক হলো তিনি সরাসরি যুক্ত থাকলেও তাঁর সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেক টেরাকোটা নির্মাণের শিল্পী হিসেবে তাঁর নাম আড়াল করা হয়েছে।তিনি এই বিষয়ে প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে আগ্রহী হননি। প্রচারবিমুখতার জন্য তিনি দীর্ঘ কর্মময় জীবনের বহু সাফল্য ও কৃতিত্বকে আড়াল করে গেছেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। গত ৬ মার্চ বুধবার এই মহান শিল্পী বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের জগৎকে শোকের ছায়ায় নিমজ্জিত করে ৬৮ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছেন। তাঁর সৃষ্ট-মা ও শিশু, রথ হাতি, ঘোড়া, সাইকেল আরোহী ইত্যাদি শিল্পকর্মের মাধ্যমে তিনি এ দেশের মৃৎশিল্পের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন অগণিত কাল পর্যন্ত। বারবার তিনি ফিরে আসবেন শিল্পের ইতিহাস-ঐতিহ্যবিষয়ক গবেষকদের মধ্যে।
২৪ মার্চ/২০১৩/নিউজরুম.