ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘদিন ব্যাংকটি সে লক্ষ্য অনুযায়ী দরিদ্রদের অর্থায়ন করে আসছিল। দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা পালন করে আসছিল ব্যাংকটি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকটির মোট অর্থের একটি বড় অংশ গ্রাহকদের মাঝে ঋণ হিসেবে বিতরণ না করে সহজে মুনাফা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ব্যাংকটি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা দরিদ্রদের ঋণ হিসেবে না দিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রেখেছে। এতে ব্যাংকটির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের দরিদ্র মানুষ। সহজ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদে মুনাফা বাড়ানোর জন্য ক্ষুদ্রঋণের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক বিনিয়োগ করছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গ্রামীণ ব্যাংকের ২০১৭ সালের কার্যক্রমের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরে সদস্যদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের সুশাসনেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণাঙ্গ পর্ষদ না থাকা, ২০১৭ সালে পর্ষদের কোনো সভা অনুষ্ঠিত না হওয়া, প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে ব্যাংক পরিচালনার কারণে সুশাসনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালকরা।
সম্প্রতি পরিদর্শন শেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে ব্যাংকটির আমানত, ঋণ বিতরণ, মুনাফার মতো খাতগুলোতে উন্নতি হয়েছে। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ, পুঞ্জিভূত কু-ঋণ বেড়েছে। ২০১১ সালের মে মাসে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকটি চলছে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে। এ ছাড়া ঋণ গ্রহীতা সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নির্বাচনও হয়নি সময়মতো। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মামলা। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। ২০১৬ সালে দেশব্যাপী বড় বন্যা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থায়ন করা এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পিছিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল শেষে গ্রামীণ ব্যাংকের মোট সম্পদের ৩২ দশমিক ৭৩ শতাংশ বা ৭ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা হয়েছে। ওই সময়ে ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ২৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে প্রতীয়মান হয় গ্রামীণ ব্যাংক তার সংগ্রহ করা আমানতের বড় একটা অংশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সদস্যদের মধ্যে ঋণ হিসেবে বিতরণ না করে ব্যাংকসহ লাভজনক খাতে জমা রেখে লাভের পরিমান স্ম্ফীত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থা ব্যাংকটির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করছে। এ জন্য সদস্যদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বাড়াতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
যদিও গ্রামীণ ব্যাংক দাবি করেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যে টাকা জমা রাখা হয়েছে, তা মুনাফা বাড়ানোর জন্য নয়। ঋণ বিতরণের সুযোগ না থাকায় এ অর্থ জমা রাখা হয়েছে। ব্যাংকের পরিবর্তিত পরিস্থিতি, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা এবং ঋণ চাহিদার ঘাটতির কারণে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অনেক তহবিল জমা হয়েছিল। ওইসব তহবিল অলস ফেলে না রেখে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক নিজে ঋণ বিতরণ করলে সরল হারে ১০ শতাংশ বা ক্রমহ্রাসমান ভিত্তিতে ২০ শতাংশ হারে সুদ পায়। কিন্তু কোনো ব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠানে এত মুনাফা পাওয়া যায় না। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকে জমা রাখা গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য বেশি লাভজনক হয় না।
এ বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতেই গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। আবার ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ঋণের চাহিদাও তুলনামূলক কম ছিল। যে কারণে ঋণ বিতরণ কমে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কিছু অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। সম্প্রতি এটা কমে এসেছে। তিনি বলেন, সদস্যদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। বরং ঋণ বিতরণ বাড়ানোর জন্য বর্তমানে নতুন সদস্য নেওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি বর্তমান সদস্যদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর উদ্যোগ রয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে ঘাটতি : ২০১৭ সালে ব্যাংকটিতে পরিচালনা পর্ষদের কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর পরিচালনা পর্ষদও নেই। নেই স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকও। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ জন্য স্থায়ীভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এরই মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে সদস্যদের মধ্য থেকে ৯ জন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। সরকারও তিনজন পরিচালক মনোনয়ন দিয়েছে। কয়েক বছর পরে গঠিত পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পর্ষদ গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম সভা করে।
মুনাফা যথেষ্ট নয় : ২০১৭ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ২২৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা বেশি। তবে আয়কর রেয়াত ও ব্যয় বিবেচনায় ব্যাংকটির এই মুনাফা যথেষ্ট নয় বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যান্য ব্যাংকে যে অর্থ জমা রাখা হয়েছে তা না করে সদস্যদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বাড়িয়ে মুনাফা আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সুদহার কমানোর পরামশ : গ্রামীণ ব্যাংক চার ধরনের ঋণ দেয়। উৎপাদনশীল খাতে বিতরণ করা ঋণের সুদহার সরল হারে ১০ শতাংশ বা ক্রমহ্রাসমান ভিত্তিতে ২০ শতাংশ। গৃহ নির্মাণ সুদহার ৮ শতাংশ। শিক্ষা ঋণের সুদহার শিক্ষা শেষে ৫ শতাংশ। আর ভিক্ষুকদের জন্য ঋণের সুদহার শূন্য শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদহারের তুলনায় গ্রামীণ ব্যাংকের সুদহার অনেক বেশি। গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে ঋণের সুদহার সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেতে পারে।
মেয়াদোত্তীর্ণ ও কু-ঋণ বেড়েছে : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট আমানত ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়ে ২০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর মোট ঋণ ও অগ্রিম (কর্মচারী ঋণ বাদে) বেড়েছে ২২ দশমিক ২১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ধার ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩৭ কোটি টাকা। এসবের পাশাপাশি ব্যাংকটির মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণও আড়াই শতাংশ বেড়ে ২৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে অবলোপনকৃত অনাদায়ী পুঞ্জিভূত কু-ঋণের স্থিতি বেড়েছে ১৬৭ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে অবলোপনকৃত অনাদায়ী কু-ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। মেয়াদোত্তীর্ণ ও কু-ঋণ কমানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থার অদক্ষতার কারণে এ ধরনের ঋণ বাড়ছে।
বেড়েছে প্রতারণা, জাল জালিয়াতি ও তহবিল তছরুপ : ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির ঘটনা বেশি ঘটেছে। ২০১৭ সালে সারাদেশে ৪৬৪টি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ৩২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ ঘটনাকে আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অর্থ আদায়ে নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত এমডিকে পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব পর্ষদের : গত ২৬ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ১০৪তম সভায় ব্যাংকের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত এমডি বাবুল সাহাকে পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে পরিচালকরা একমত প্রকাশ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে এক চিঠিতে বাবুল সাহাকে পূর্ণাঙ্গ এমডির দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
এ বিষয়ে মহাব্যবস্থাপক মোস্তফা কামাল বলেন, ভারপ্রাপ্ত এমডির এখন অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে থাকার কথা। পর্ষদের সুপারিশে তিনি ছুটি বাতিল করে ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত হলে সব কাজ যথাযথভাবে করার স্বাধীনতা থাকে না। নিজস্ব উদ্ভাবন, চিন্তা প্রয়োগে নানা সীমাবদ্ধতা থাকে। এতে সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনাও ব্যাহত হয়। এ জন্য ব্যাংকের স্বার্থে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ।