: সংসদে সদ্য পাস হওয়া সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ ৮ দফা দাবিতে টানা ৪৮ ঘন্টা পরিবহন ধর্মঘট পালনের পর এবার ৯৬ ঘন্টা ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সংস্কারসহ আট দফা দাবি আদায়ে ২১ দিনের সময় দিয়ে সরকারকে নোটিশ দেয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে যদি কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে টানা ৯৬ ঘন্টার ধর্মঘট পালন করা হবে বলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এ কথা বলেন। : গতকাল সোমবার ধর্মঘটের শেষদিনে বেপরোয়া আচরণ চালিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। রাজধানীর রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও চালকদের পথরোধ করে তারা মোবিল মাখিয়ে দিয়েছেন। এমনকি চালকদের শারীরিকভাবে হেনস্তা করার পাশাপাশি গাড়িতে থাকা যাত্রীদের নামিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। গত দুদিন ধরে সড়কে নৈরাজ্য চললেই সরকার নিশ্চুপ। নৌমন্ত্রী সড়ক ফেডারেশন নেতা শাজাহান খান গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে ছিলেন অনুপস্থিত। : রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও শনিরআখড়ায় বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত যানবাহনের চালকদের কান ধরে উঠবস করাতে দেখা গেছে। এ সময় সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন চালকদের গাড়ি থেকে নামিয়ে কান ধরে উঠবস করান পরিবহন শ্রমিকরা। এর আগে তারা চালকসহ যাত্রীদের মুখে পোড়া মোবিল লাগান। এই মোবিল থেকে রেহাই পায়নি স্কুলছাত্রীরাও। সাংবাদিকসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেও ছাড় দেননি তারা। এবার পরিবহন শ্রমিকরা আরও জঘন্য পথ বেছে নিয়েছেন। ধর্মঘটে গাড়ি বের করায় তারা ব্যক্তিগত যানবাহনের চালকদের কান ধরে উঠবস করাচ্ছেন। : সরেজমিন দেখা গেছে, পরিবহন ধর্মঘট থাকায় রাজধানীজুড়ে হাজার হাজার মানুষকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। শ্রমিকদের তান্ডবে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস সহকারী কাজী মেহেদী হাসান। তিনি জানান, কাজলা থেকে সচিবালয়ের উদ্দেশে আসার পথে সকাল ৮টার দিকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে তাদের গাড়ি আটকে দেয়া হয়। সেখানে শ্রমিকরা তান্ডব চালালে কয়েকজন পথযাত্রী তা ভিডিও করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উপস্থিত যাত্রীদের পোড়া মোবিল মেখে দেয় শ্রমিকরা। তিনি বলেন, এতে সপ্তাহের প্রথম দিনের কর্মদিবসের আসার পথে তার পোশাক নষ্ট হয়ে যায়। : ধর্মঘটে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দূরযাত্রার মানুষ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তি বেড়েছে। সড়কে যান চলাচল না থাকায় পায়ে হেঁটে কিংবা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ও সিএনজিতে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এ সুযোগে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার চালকরা দুই গুণের বেশি ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। : জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ডাকা এ পরিবহন ধর্মঘটে পরিবহন সংকটে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের। সমুদ্র ও স্থলবন্দরগুলোতে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ট্রাকের জট বাড়ছে। কোথাও কোথাও লাঠিসোটা নিয়ে যাত্রীদের ওপর হামলাও চালিয়েছে শ্রমিকরা। : এ সংগঠনের ডাকে পরিবহন শ্রমিকরা গত রবিবার ভোর থেকে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারা দেশে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এতে পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। : ব্যক্তিগত গাড়ির এক চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার গাড়িতে অসুস্থ এক রোগী ছিলেন। রোগী নিয়ে খুলনায় যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথে শ্রমিকরা আটকায়। আমি তাদের কাছে হাতজোড় করে মাফও চেয়েছি। কিন্তু তারা কথা না শুনে মুখে মোবিল মাখিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে গাড়ির গ্লাসেও মোবিল মাখিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান ওই চালক। অপর এক চালক বলেন, আমি মাদারীপুর যাচ্ছিলাম। গাড়িতে অসুস্থ রোগী ছিলেন। কিন্তু পোস্তগোলা ব্রিজ এলাকায় রোগীকে নামিয়ে দিয়েছে শ্রমিকরা। একই সঙ্গে আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। : টার্মিনালগুলোতে পরিবহন শ্রমিকদের কড়া পাহারা ছিল লক্ষণীয়। শ্রমিকরা রাস্তার বিভিন্নস্থানে লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান করে। ব্যক্তিগত অনেক গাড়িও ভাঙচুর ও চলাচলে বাধা দেয়। গণপরিবহন সংকটের কারণে অফিসগামী, শিক্ষার্থী, রোগী, প্রবাসীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। দীর্ঘ সময়ের বিরতিতে বিআরটিসির বাস এলেই তাতে হুমড়ি খেয়ে যাত্রীদের উঠতে দেখা গেছে। এমনকি বাসের পেছনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়েও অনেক যাত্রীকে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। : রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় গাড়ি নামানোর অপরাধে প্রকাশ্যে চালকের মুখে পোড়া মোবিল মাখিয়ে দিয়েছে। তাদের এ তান্ডরেব হাত থেকে রক্ষা পাননি যাত্রীরাও। প্রসঙ্গত, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সংসদে সড়ক আইন পাস করেছে সরকার। : চালকদের অভিযোগ, পোস্তগোলা ব্রিজ এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক মো. জাবেদ। চালকদের হেনস্তা করার সময় এসআই জাবেদ ঘটনাস্থলের কাছাকাছি অবস্থান করলেও শ্রমিকদের বাধা দেননি। : সড়ক পরিবহন আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন ও সাজা কমানোর দাবিতে দুই দিনের কর্মবিরতির ডাক দেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশন। কর্মবিরতিতে রাজধানী ঢাকা ও আন্তঃজেলায় পরিবহন যোগাযোগ অচল হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী জানান, আমরা পুলিশ কমিশনারকে বলে দিয়েছিÑ এমন আপত্তিকর ঘটনা যারা ঘটাচ্ছেন, পুলিশ যেন তাদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়। : ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘আমাদের চলমান কর্মবিরতি আজ মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত শেষ হবে। এরপর পরিবহন চলবে। আগামীকাল থেকে ২১ দিন সময় দিয়ে আমরা সরকারকে চিঠি দেব। চিঠিতে আমরা সরকারকে আমাদের দাবির ব্যাপারে অবহিত করব। আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে না নিলে ২১ দিন পর আবারও ৯৬ ঘন্টার ধর্মঘটে যাব।’ তিনি বলেন, ‘এই ২১ দিনের মধ্যে আমরা দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও টার্মিনালে মিটিং- মিছিল ও সমাবেশ করব। সেখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করা হবে। আমাদের কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ।’ : গত রবিবার সচিবালয়ে নিজ দফতর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের কাছে সাংবাদিকরা পরিবহন শ্রমিকদের কর্মসূচির বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এরপরও সাংবাদিকরা বারবার প্রশ্ন করতে থাকলে মন্ত্রী বলেন, তিনি এ ধর্মঘটের বিষয়ে জানেন না। কোনো মন্তব্য করবেন না। তবে নির্বাচনের আগে এই সময় সড়ক পরিবহন আইন পরিবর্তন করে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়া সম্ভব নয় জানিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। : পরিবহন শ্রমিকদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এখন আইন পরিবর্তনের সুযোগ নেই। পরবর্তী সংসদ অধিবেশন পর্যন্ত শ্রমিকদের অপেক্ষা করতে হবে। ন্যায়সঙ্গত বিষয় থাকলে তখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আইন সংশোধনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের বলতে চাই, এখনই ধর্মঘট প্রত্যাহার করুন। মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনো লাভ নেই। : এছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তারা যে কারণে ধর্মঘট করছেন, সেটা বোধহয় আইনটা সঠিকভাবে না বুঝে করছেন। সড়ক পরিবহন আইন যেটা হয়েছে আমার মনে হয় সেটা সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সহায়ক হবে এবং চালকরা যদি সঠিকভাবে গাড়ি চালায়, তাহলে তাদের জন্য সহায়ক হবে। আইনে এমন কোনো প্রভিশন (বিধান) নেই যে, তারা অন্যায় না করা সত্ত্বেও তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হবে। আমি তাদের আহ্বান জানাব, তারা যেন এই পথ পরিহার করে। : : আবদুল্লাহ জেয়াদ, দিনকাল :