চিকিৎসকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য সেবা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বেলা শেষে দাবি দিয়ে তো লাভ নেই। যদি জনগণ ভোট দেয়, আবার ক্ষমতায় আসতে পারলে আপনাদের দাবিগুলো বিবেচনা করব। গতকাল বিকালে গণভবনে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চিকিৎসক সম্মিলন-১৮ অনুষ্ঠানে তাদের ১৬ দফা দাবিনামা হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখে এসব কথা বলেন। এ সময় তাদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দাবিনামা দেখিয়ে বলেন, ‘এটা আমি ফেলে দেইনি, রেখে দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখানে একটা দুঃখের কথা বলতে চাই। উপজেলা হাসপাতালগুলোকে উন্নতমানের করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের ৫০ বেডের একটা হাসপাতাল সেখানে কমপক্ষে ১০ জন ডাক্তার থাকার কথা। কিন্তু কোথাও কোথাও একজন, খুব বেশি হলে চারজন। সেখানে যদি ডাক্তার না থাকে, মানুষ তাহলে সেবা পাবে কীভাবে? এটা আমার প্রশ্ন। শেখ হাসিনা বলেন, পদ আমরা সৃষ্টি করে দিয়েছি, কিন্তু সেখানে আমরা ডাক্তার পাই না। নিয়োগও আমরা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কেন এই অবহেলা মানুষের প্রতি? এটা নিশ্চিয়ই মানুষ আকাঙ্ক্ষা করে না। সেটা আমি আপনাদের ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব। মানুষের সেবা করাটা প্রথম কর্তব্য উল্লেখ করে চিকিৎসকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবাটা নিশ্চিত করতে হবে। সেদিকে বিশেষভাবে নজর দেবেন বলে আমি আশা করি। তৃণমূলে চিকিৎসকদের আবাসন সমস্যার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা অসুবিধা আছে সেখানে, সেটা হলো— থাকার অসুবিধা। সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রতিটি উপজেলায় আমরা বহুতল বিশিষ্ট ফ্ল্যাট তৈরি করে দেব। যারাই যাবে তারা যেন ভাড়া থাকতে পারেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজকে উন্নতমানের হাসপাতাল হিসেবে নতুন করে নির্মাণ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেখানে শত বছরের পুরনো বিল্ডিং, কেউ কেউ এটাকে হেরিটেজ বলেন। কিন্তু হেরিটেজ মাথায় ভেঙে পড়লে কী হবে সেটা আর কেউ ভাবে না। আমি নতুন প্ল্যান তৈরি করেছি। অত্যন্ত আধুনিক মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল আমরা নির্মাণ করে দেব। ইতিমধ্যে আমরা শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি। নতুন হাসপাতাল হলে এই শয্যা সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা ১০ বছর পার করছি। এর আগে ছিলাম পাঁচ বছর। বাংলাদেশের মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ক্ষমতাকে আমরা হাতে নিয়েছি এই চিন্তা থেকে যে, জনগণের সেবা করা আমার কর্তব্য, আমার দায়িত্ব। নিজেরা কী পেলাম, না পেলাম সে চিন্তা করি না। চিন্তা একটাই মানুষকে কতটুকু দিতে পারলাম। চিকিৎসক নিয়োগের কথা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ১২ হাজার ৫৪৬ জন চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি। বিসিএস-এর মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসকদের জন্য বিসিএস-এর একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এর রেজাল্ট ভীষণ ইন্টারেস্টিং। এতে ৬০ ভাগ মেয়ে ও ৪০ ভাগ ছেলে পাস করেছে। এ সময় মজা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানে সারাবিশ্বে জেন্ডার গ্যাপ কমাতে বলা হয় সেখানে আমাদের দেশে উল্টো ছেলেদের ফল খারাপ। এখানে যেন ছেলেদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে জেন্ডার গ্যাপ কমাতে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। এ জন্য আমি ছেলেদের পড়াশোনায় একটু বেশি মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা অন্তত মেয়েদের সমান সমান হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের বড়লোক বিত্তবানরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাক তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ তারা যাতে চিকিৎসা সেবা পায় সেটা আমাদের দায়িত্ব। এ জন্য দরকারি সব কিছু করার পাশাপাশি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা এবং বিদেশিদের দেশে এনে সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ সময় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ১৬ দফা দাবিনামা হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখে বলেন, বেলা শেষে দাবি দিয়ে তো লাভ নেই। ১৬ দফা দাবি বিবেচনার সময় নেই। যদি বাংলাদেশের জনগণ আমাদের ভোট দেয়, যদি নির্বাচিত হয়ে আবারও সরকার গঠন করতে পারি তাহলে এসব দাবি বিবেচনা করব। তিনি বলেন, একটা সরকার পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। কিন্তু ওই পাঁচ বছরের সময় শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন সরকার শুধু রুটিন কাজগুলো করতে পারে। এখন আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছি। বক্তব্যের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বিএসএমএমইউ) বঙ্গবন্ধু দেশের প্রথম ব্লাড ব্যাংক উদ্বোধন করার সময়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা ডাক্তার। আপনাদের মন হতে হবে অনেক উদার। আপনাদের মন হবে সেবার। আপনাদের কাছে বড় ছোট থাকবে না। আপনাদের কাছে থাকবে রোগ। কার রোগ বেশি, কার রোগ কম। তাহলেই তো সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে এবং মানুষের মনে আপনারা সহযোগিতা পাবেন।’ আগামী দিনের উন্নয়ন পরিকল্পনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ হবে উন্নত, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। সোনার বাংলাদেশ গড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণ করব ইনশা আল্লাহ।
বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন, কনফেডারেশন ফর মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইন এশিয়া অ্যান্ড ওশেনিয়া (সিএমএএও)-এর সভাপতি রাভিন্দ্রান আর নাইডু, বিএমএ’র মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া।নিজস্ব প্রতিবেদক