বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করাই আসল লক্ষ্য। অন্য কোনো কিছুই যেন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। রাহুল গান্ধী এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়েই বলেছেন, মোদি সরকারকে সরানোর লক্ষ্যে যে সার্বিক বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, তাকে কোনোভাবে বিচ্যুত হতে দেওয়া যাবে না। বিরোধী জোট নির্বাচনে জিতলে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেই প্রশ্নটিও তিনি আপাতত সতর্কভাবেই সরিয়ে রাখতে চাইছেন।
গত মাসে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির যে বর্ধিত বৈঠক হয়েছে, সেখানে কংগ্রেসের একশ্রেণির স্তাবক নেতা অতি আগ্রহে রাহুল-বন্দনা শুরু করেছিলেন। সে সময় তারা বলছিলেন, বিরোধী জোট তৈরি হচ্ছে কংগ্রেসকে কেন্দ্র করেই। এটুকু বলেও যদি তারা থেমে যেতেন তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু আরও এক ধাপ এগিয়ে তারা বলতে শুরু করেন, সেই জোটের প্রধানমন্ত্রী পদের মুখ হবেন রাহুল গান্ধীই।
তাদের এই বালখিল্যপনার ফল যে কী বিষময় হয়েছে, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন কংগ্রেস সভাপতি। শুধু এই কথাটিতেই বিরোধী শিবিরে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। তার কিছুটা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আর কিছুটা অন্তঃসলিলা নদীর মতোই বইছে বিরোধী শিবিরে। সে কারণেই আর বিশেষ কালক্ষেপণ না করে তড়িঘড়ি আসরে নেমে ড্যামেজ কন্ট্রোল করেছেন রাহুল। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্ন যাতে কোনোভাবেই মূল লক্ষ্যকে সরিয়ে দিতে না পারে, সেদিকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য রাখতে হবে। ভোটের ফল প্রকাশের পর দলগত প্রাপ্ত আসনের বিচারে তখন স্থির করা যাবে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। আরও এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলেছেন, উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী বা পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রী হলেও তার কোনো আপত্তি থাকবে না।
রাহুলের নেওয়া সর্বশেষ কৌশল অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে কংগ্রেস যখন হাওয়ায় নাম ভাসানো থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকছে, তখন এরপর মমতা, মায়াবতী কিংবা অন্য কেউ আর এ ব্যাপারে নিজেদের ঢাক পেটানোর সুযোগ পাবেন না। অন্যথায় কংগ্রেস যদি রাহুলের নামে এখন থেকেই জোরালো প্রচার শুরু করত, সে ক্ষেত্রে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মমতা, মায়াবতী কিংবা শারদ পাওয়ার কিংবা মুলায়ম এ রকম অনেকেরই নাম তখন নিত্য প্রচারের আলোয় আসার সুযোগ পেত। তাই প্রকৃতপক্ষে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে, মমতা ও মায়াবতীকে আপাতত সাইডলাইনের বাইরে পাঠাতেই কৌশলী রাহুল, তবে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে কোনো নামের মধ্যে ওই দুজনের নামও তিনি জিইয়ে রেখেছেন।
উল্লেখ্য, কংগ্রেসের একশ্রেণির নেতার আতিশয্যের পর সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব বা কর্ণাটকের জেডির (এস) তরফে কোনো উল্টো সুর শোনা যায়নি। মুলায়মপুত্র অখিলেশ জোটের ব্যাপারে প্রথম থেকেই রাহুলের পাশে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। আর প্রবীণ দেবগৌড়া কিছুটা কৃতজ্ঞতাবশতই সেদিন রাহুলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভিন্ন সুর আসতে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের বিএসপির নেত্রী মায়াবতী ও বিহারের আরজেডি শিবির থেকে। মায়াবতী খানিকটা আগ বাড়িয়েই বলে বসেন, সম্মানজনক শর্ত না হলে বিএসপি এই জোটে আগ্রহী নয়! আর অন্যদিকে আরজেডির তেজস্বী যাদব রাহুল গান্ধীর নাম না করেও বলেন, সাধারণ নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রী পদে আরও অনেক নাম উঠে আসতে পারে।
জোটের নেতাদের মধ্যে এই সংশয় যাতে আর বাড়তে না পারে, সে কারণে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন রাহুল। পাকা রাজনীতিবিদের মতোই তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের বিষয়টি লঘু করে দিয়ে আসলে যা বলতে চেয়েছেন, তা হলো কাঁঠাল নামানোর ব্যবস্থা না করে গোঁফে তেল দেওয়া অর্থহীন।
প্রধানমন্ত্রী পদে এখন থেকেই রাহুল গান্ধীর নাম ঘোষণা করে বিরোধী শিবিরে বিভ্রান্তি ও অস্বস্তি যে তৈরি করবে না, তা আগেই জানিয়েছিল কংগ্রেস। এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী জানিয়ে দিলেন, বিজেপিকে হারানোই আসল কথা। যে বিজেপি এবং আরএসএসকে হারাতে পারবে, তাকেই সমর্থন করবে কংগ্রেস। এমনকি বিজেপিকে হারাতে মায়াবতী বা মমতা ব্যানার্জিকে মেনে নিতেও তার আপত্তি নেই।
পরে আসরে নামেন কংগ্রেসের বাকি নেতারাও। কংগ্রেসের শীর্ষ মহলের মতে রাহুল মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী পদের থেকেও এই মুহূর্তে বেশি দরকার বিজেপিকে হারানো। মমতা সম্পর্কে তার মত, তৃণমূল নেত্রী কংগ্রেস থেকে এসেছেন। ফলে বিজেপির সঙ্গে তিনি থাকবেন না। পশ্চিমবঙ্গে জোট নিয়েও জট কেটে যাবে।
তবে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সে বিষয়টি এখন আলোচনা না করে ভোট-পরবর্তী সময়ের জন্য অপেক্ষা করাই শ্রেয়। কারণ সাধারণ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে বিরোধী অনেক দলেরই বর্তমান অবস্থান বদলে যেতে পারে। এখন যারা কোনো অবস্থান নিচ্ছে না, তারাও প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবি জানাতে পারে। ভোটের পর বড় দল হিসেবে উঠে এলে স্বাভাবিকভাবেই দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাহুল গান্ধীর নামই উঠে আসবে। গতকাল এনসিপির শারদ পাওয়ারও সেই ইঙ্গিত দিয়েই বলেছেন, মানুষ রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিলে এনসিপি আপত্তি করবে কেন?
এর পাশাপাশি ভাঙনের চিহ্ন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে শাসক শিবিরে। মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। ভারতের সংসদে এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের সময় মোদি সরকারের পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, সংসদের রাস্তা পর্যন্ত মাড়ায়নি তাদের শরিক শিবসেনা। তার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছে দুই পক্ষের বিবৃতির লড়াই। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে জানিয়ে দিয়েছেন, মহারাষ্ট্রে শিবসেনাকে বাদ দিয়ে একাই চলবে বিজেপি। তিনি বলেছেন, কোনোরকম তিক্ততা নিয়ে জোট বজায় রাখার পক্ষপাতী নন তারা। তাই প্রয়োজনে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে একাই লড়বে বিজেপি। মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোট এখনো রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে ভাঙনের সম্ভাবনাই ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে।
বিজেপি ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, লোকসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে সবকটি আসনেই প্রার্থী দেবে। দলের কর্মীদেরও সেইমতো নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-এর নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যেই ২৩টি বিষয়সংবলিত একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রের সব সোশ্যাল মিডিয়া সেলগুলোকে আরও সক্রিয় করার নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ। লোকসভা নির্বাচনে শিবসেনার সমর্থন ছাড়াই যে লড়তে হবে, মহারাষ্ট্রের কর্মী-সমর্থকদের সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন অমিত শাহ। সেনাসূত্রের খবর, লোকসভার ভোটাভুটিতে সমর্থন দেওয়ার জন্য শিবসেনা-প্রধানকে ফোন করেছিলেন অমিত শাহ। কিন্তু সেই অনুরোধ রাখতে অস্বীকার করে শিবসেনা।
বস্তুত, অনাস্থা-বিতর্কের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসা শিবসেনার কাছেও এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সম্প্রতি শিবসেনার নেতা উদ্ধব ঠাকরে একটি ভিডিও প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে এবার খোলাখুলি বিরোধিতা করবে শিবসেনা। উল্লেখ্য, অনাস্থা ভোটে দলের ১৮ সাংসদ বিরত থেকেই ওই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। এ ছাড়া সংসদে রাহুল গান্ধীর প্রশংসায় ইতোমধ্যেই সরব হয়েছে শিবসেনা। উদ্ধব জানিয়েছেন, শিবসেনার কাঁধে বন্দুক রেখে কাউকে গুলি চালাতে দেওয়া হবে না। অর্থাৎ মোদি সরকারের ইস্যুভিত্তিক বিরোধিতার লাইনই নিচ্ছে শিবসেনা। তিনি বলেন, একসময় বিজেপিকে খোলাখুলি সমর্থন করেছে শিবসেনা। এবার বিরোধিতাও হবে প্রকাশ্যেই।
উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা অনাস্থায় মোদি সরকারের পক্ষে ভোট না দেওয়ায় এনডিএর কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু তাতে দুই পক্ষের মধ্যে ফাটল আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিজেপির সঙ্গে শিবসেনার সম্পর্ক আরও তলানিতে গেল বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
শুধু শিবসেনাই নয়, মোদি-শাহের সমালোচনায় সরব হয়েছেন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার রাজ ঠাকরেও। তার মতে মহারাষ্ট্রে কেউ কথা রাখেননি— না নরেন্দ্র মোদি, না দেবেন্দ্র ফড়নবীশ। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মারাঠাদের জন্য আসন সংরক্ষণের নাম করে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন ফড়নবীশ। তিনি ঘোষণা করেছিলেন বোম্বে হাই কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী প্রায় ৭২ হাজার পদে কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ১৬ শতাংশ আসন মারাঠা সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বহুদিন ধরে আসন সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছে মারাঠা সংগঠনগুলো। বোম্বে হাই কোর্ট এখনো এ ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দেয়নি।
রাজ ঠাকরের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি প্রধানমন্ত্রীও। তিনি বলেছেন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে এসে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন মোদি। কিন্তু নোটবন্দী, জিএসটি আর স্বচ্ছ ভারত নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছে বিজেপি সরকার। মোদি নিজের এলাকা বারাণসীতেই গঙ্গা নদীর সংস্কার করতে পারেননি।
লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।