অর্থঋণ আদালতে – ছবি : সংগৃহীত
মারুফ হাসান। বাসা রামপুরা বনশ্রীতে। চাকরি করেন একটি ব্যাংকে। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন কাটান আদালতের বারান্দায়। ব্যাংকার হয়ে প্রতিদিন আদালতে যান কেন, প্রশ্ন করতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, তিনি ব্যাংকে বিনিয়োগ শাখায় কাজ করেন। তার শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন অনেকেই; কিন্তু তাদের একটা বড় অংশ ঋণ পরিশোধ করছেন না। বাধ্য হয়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন খেলাপিদের বিরুদ্ধে। মামলাগুলোর দেখাশোনা করতেই প্রতিদিন হাজির হন আদালতে। তিনি জানান, ঋণ দিয়ে ব্যাংক পড়েছে বিপাকে। যারা আগে ব্যাংকের অর্থ নিয়মিত পরিশোধ করতেন, তারাও এখন আর ঋণ পরিশোধ করছেন না। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার আদালত স্বল্পতার কারণে মামলাগুলোও যথাযথ সময়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ঋণ আদায় করতে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে এবং মামলা পরিচালনা করতে ব্যাংকের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
জনগণের আমানত দিয়ে ঋণ দিয়েছিলেন তারা। সেই ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না ঋণগ্রহীতারা। বাধ্য হয়ে গ্রাহকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন ঋণ আদায়ের জন্য আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে তাদেরকে। এমনিভাবে শুধু অর্থঋণ আদালতেই গ্রাহকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ের জন্য। মামলা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
মামলাগুলো নিষ্পত্তির হার নিয়েও সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন ব্যাংক বাদে মোট ১১টি ব্যাংকের মামলা নিষ্পন্নের হার ২০ শতাংশেরও কম। এর মধ্যে দু’টি ব্যাংক কোনো মামলাই নিষ্পত্তি করতে পারেনি, যা হতাশাব্যঞ্জক। আবার যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ওইসব মামলার বিপরীতে দাবিকৃত অর্থও ঠিক মতো আদায় হচ্ছে না। যেমন আটটি ব্যাংকের নিষ্পন্ন মামলার বিপরীতে আদায়ের হার ২০ শতাংশের কম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন দু’টি বিশেষায়িত ব্যাংকের এক হাজার ৯৬১ কোটি টাকার বিপরীতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছয় হাজার ২৯টি। সবচেয়ে বেশি বিচারাধীন মামলা আছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকগুলোর ২৫ হাজার ১১১টি মামলার বিপরীতে আটকে আছে ৪৩ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। আর বিদেশী ৯ ব্যাংকের এক হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার বিপরীতে মামলা বিচারাধীন আছে সাত হাজার ৬৪৪টি। সব মিলে প্রায় ৫৮ হাজার মামলার বিপরীতে আটকে আছে প্রায় সাড়ে ৮৮ হাাজার কোটি টাকা, যা ছয় মাস আগেও ছিল ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। অনেক দিন ঘুরে মামলা নিষ্পত্তিও হচ্ছে; কিন্তু আইনগত জটিলতার কারণে আসামিদের আইনের আওতায় আনা যায় না। আদায় হয় না নিষ্পন্ন মামলার বিপরীতে দাবিকৃত অর্থ। ফলে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর আয়ের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে। এভাবে ব্যাংকের আয় এবং মূলধনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কমে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা। খেলাপি ঋণের বাড়তি চাপ সমন্বয় করতে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহারও কমাতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বড় ঋণখেলাপিরা ঋণ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে তা পরিশোধ করছেন না। তাদের বিরুদ্ধে সরকার শক্ত কোনো পদক্ষেপও নিচ্ছে না। এতে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও এখন আর ঋণ পরিশোধ করছেন না। ফলে খেলাপি ঋণ দেশে এখন এক অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক বাধ্য হয়ে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে; কিন্তু ঋণখেলাপিরা খ্যাতিমান আইনজীবীদের দিয়ে মামলা পরিচালনা করে দীর্ঘ দিন তা আটকে রাখছে। বিপরীতে ব্যাংকগুলো মামলা পরিচালনা করছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল আইনজীবীদের দ্বারা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যাংকগুলো ভালো আইনজীবীদের দ্বারা মামলা পরিচালনা করে তা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে পারে। অপর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নিতে পারে। যেমন প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সাথে বৈঠকে বসে আলাদা বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে অনুরোধ করতে পারে। একই সাথে বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক রায় দিয়ে অন্যদের ঋণ পরিশোধে প্রভাবিত করা যায়। অন্যথায় মামলাজট দিন দিন বাড়বে।