একজন লেখকের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বই। নিজেকে সৃজনমুখর করতে বইয়ের বিকল্প নেই। বইয়ের স্পর্শ, গন্ধ ও অক্ষর-সমুদ্র সবসময়ই আন্দোলিত করে লেখককে। বাংলা ট্রিবিউন সাহিত্য বিভাগের লিখিত প্রশ্নে আমরা শুনতে চেয়েছি এ সময়ের পড়ুয়া লেখকের বইপড়ার গল্প।
বাংলা ট্রিবিউন : আপনার পড়া প্রথম বইয়ের নাম মনে আছে? বইটি কীভাবে পেলেন? প্রচ্ছদ বা ভিতরের পৃষ্ঠাগুলো কেমন, পড়ার অনুভূতি কেমন—ইত্যাদি গল্প শুনতে চাই।
চঞ্চল আশরাফ : পূর্ণাঙ্গ কোনো বই পড়ার চেয়ে আমার ভালো লাগতো পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো গল্প, কিংবা কোনো কবিতাগ্রন্থের কোনো কবিতাংশ; বুঝতেই পারা যাচ্ছে, আমার ধৈর্যে গোলমাল ছিল। তবে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র যখন আমি, পড়েছিলাম একটা ভ্রমণগ্রন্থানুবাদ, ‘আটলান্টিকে ঊনত্রিশ দিন’। স্কুলের পাঠাগার থেকেই নিয়েছিলাম, ছুটির দিনে পড়বো বলে। বইটিরপ্রচ্ছদে ছিল হালকা নীল পটভূমিতে পালতোলা কালো একটি নৌকার আধখানা ছবি, যত দূর মনে পড়ে। লেখকের নাম মনে নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে, আপনি জানতে চাইছেন, সাহিত্যের কোন বইটি প্রথম পড়েছি। তা পড়তে আমার অবশ্য দেরিই হয়েছিল, হ্যাঁ, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন আমি, পড়েছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কির আমার ছেলেবেলা বইটি পেয়েছিলাম বড়মামার কাছ থেকে (তিনি আজ নেই), তিনি রুশ সাহিত্যের খুব অনুরাগী ছিলেন। বইটি ছিল বাঁধাইকরা, ফলে প্রচ্ছদ দেখার সুযোগ ঘটেনি; ছিল পুরনো অথবা আমার আগে অনেকেই পড়েছিল বলে এমনটি মনে হতে পারে। পৃষ্ঠাগুলো হলদেটে ছিল, পুরনো বা অতিব্যবহৃত হলে যেমনটি হয়ে থাকে। আমার এখন শুধু নিকিতিনের কথা মনে পড়ছে, যে ছিল লেখকের মামা, গিটার বাজাতো; সেই ঊনিশ শতকের দারিদ্র্যপীড়িত রাশিয়ার শিশুদের দেখতে পাচ্ছি, যারা অপেক্ষা করতো আধখানা রুটির জন্য। বইটি পড়ার পর ঠিক করেছিলাম, গরিবি দশা নিয়ে রচিত কোনো বই আর পড়বোনা। এধরনের বই একটার বেশি পড়া ঠিক নয়।
বাংলা ট্রিবিউন : সর্বশেষ কী বই পড়লেন—বইটির পাঠ অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
চঞ্চল আশরাফ : সংগ্রহে থাকা পুরনো বইগুলোর মধ্যে যখন যেটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সেটিই ঘুরেফিরে পড়ি। কিছুদিন আগে যেমন পড়েছি ‘দ্য থিয়েটার অব রিভোল্ট : অ্যান অ্যাপ্রোচ টু মডার্ন ড্রামা’। বইটির লেখক রবার্ট ব্রাস্টেইন; তিনি সম্ভবত এখনও জীবিত, জন্মেছেন ১৯২৭ সালে, নিউইয়র্কে। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে, যাতে রয়েছে ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, চেখভ, শ, ব্রেখট, পিরানদেল্লো, ও’ নিল, আর্তো ও জেনের নাটক সম্পর্কে আলোচনা। বইটি আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, বিশ শতকের শুরুতে গড়ে ওঠা নাট্যবিদ্রোহকে বুঝতে এটি সাহায্য করে, এটাও উপলব্ধ হয় যে, বিসমার্কের সময়কার জর্মন সাহিত্য ও দর্শন, বিশেষত নিৎশের রচনা বিশ শতকের শিল্পকলায় কেমন প্রভাব ফেলেছিল। কয়েকদিন ধরে ফের পড়ার চেষ্টা করছি সুসান সনট্যাগের ‘অ্যাগেইনস্ট ইন্টারপ্রিটেশন।’ চোখে সমস্যা, পড়তে কষ্ট হয়; কিন্তু পড়ার জন্য নিজের ওপর জবরদস্তিতেও আমার আপত্তি নেই, বরং সুখ বোধ করি। যা হোক, বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে, যাতে রয়েছে সনট্যাগের সেরা কিছু প্রবন্ধ, তবে মূল রচনা ‘অ্যাগেইনস্ট ইন্টারপ্রিটেশন’, যাতে বলা হয়েছে শিল্পের মরমি গুরুত্বের জায়গাটি দখল করেছে বৌদ্ধিক অভিনিবেশ। তিনি লিখেছেন, ব্যাখ্যা হলো ‘শিল্পের ওপর বুদ্ধির প্রতিশোধ।’ আর ‘সাধনা আহমেদের দুটি নাটক’ বইটি পড়েছি। তাতে ‘দমের মাদার’ আর ‘মাতব্রিং’ নামের দুটি নাটক রয়েছে; প্রথমটিতে দেখানো হয়েছে ধর্মের উদারপন্থার ওপর কট্টরবাদীদের সহিংস আধিপত্যহেতু মানবতার বিপর্যয়; দ্বিতীয়টি রচিত হয়েছে কেন্দ্র কিভাবে প্রান্তকে গ্রাস করে, তা নিয়ে। এখনকার পৃথিবীর যে দশা, তাতে সাধনা আহমেদের এ বইটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন : কিনে রেখেছেন, পড়া হয়নি কিন্তু পড়ার জন্য ভেতরে এক ধরনের চাপ অনুভব করেন—এমন বই সম্পর্কে জানতে চাই।
চঞ্চল আশরাফ : কেনা বেশ কটি বই আমার অপঠিত রয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে আছে ২৪ বছর আগে কেনা বইও, যেমন জেমস জয়েসের ইউলিসিস, ভার্জিনিয়া উলফের বিটুইন দ্য অ্যাক্টস, এডওয়ার্ড সাইদের কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম। এগুলোর প্রতিটিরই কিছু অংশ অবশ্য পড়েছি। এডওয়ার্ড সাইদের বইটি প্রকাশের পরের বছরই কিনেছিলাম, দোকানের শেলফ থেকে হাতে নিয়ে যখন দেখলাম, তাতে জোসেফ কনরাডের `হার্ট অব ডার্কনেস’ নিয়ে বড়সড় একটা প্রবন্ধ, আর দেরি করিনি, কিনে ফেলেছিলাম। জয়েসের `ইউলিসিস’ ১৬-১৭ পৃষ্ঠা পড়তে পেরেছিলাম বলে মনে পড়ে, বইটি আমি পড়তে চাই। সম্ভব হয়ে উঠবে কিনা জানি না। কয়েক বছর আগে কেনা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘লিভিং টু টেল দ্য টেইল’ আর তপন রায়চৌধুরীর ‘বাঙালনামা’ পুরোপুরি পড়া হয়ে ওঠেনি। দু’বছর আগে বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ড. পরিতোষ দাশের বাংলা অনুবাদ করা এডমান্ড হুসার্লের ‘আইডিয়াস’ কিনেছিলাম। খুব আগ্রহ নিয়ে বইটি কিনেছিলাম, পড়তে গিয়ে ফের বুঝতে পারলাম, বাঙালির পক্ষে সম্ভব নয় দর্শন বিষয়ক বইয়ের বোধগম্য অনুবাদ। তবে সোহেল হাসান গালিবের ‘বাদ-মাগরিব’ কিনেছিলাম গত বইমেলায়, ভাষার রাজনীতি সংক্রান্ত বই, পড়া হয়ে উঠলো না এখনও। ভাবছি, শিগগিরই পড়বো।
বাংলা ট্রিবিউন : কোন কোন বই পড়ার আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু সংগ্রহে নেই?
চঞ্চল আশরাফ: মার্কুয়েস দে সাদের ‘ফিলোসফি ইন দ্য বেডরুম’। পড়তে চাওয়ার কারণ সম্ভবত এর নাম। বইটির উল্লেখ পেয়েছিলাম ফরাসি প্রতীকবাদ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে এবং কুমারদার (কুমার চক্রবর্তী) সঙ্গে আলাপও হয়েছিল এ বিষয়ে। সংগ্রহে না থাকা আর কোনো বই পড়ার আগ্রহ বোধ করছি না এই মুহূর্তে, মনে হয়, নতুন করে কিছুই আর মিলবে না, মানুষ একটা ডেড এন্ড বা বর্ডারলাইনে এসে গেছে; অথবা তার মৃত্যু ঘটেছে; হয়তো আমিও মরে গেছি, কেননা, কিছুতেই আলোড়ন বোধ করি না আজকাল।
বাংলা ট্রিবিউন : কোন বইটি সবচেয়ে প্রিয়, বারবার পড়তে চান? কেন?
চঞ্চল আশরাফ: বেশ কিছু বই আমার প্রিয়, তবে সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটি, বলা মুশকিল। কিছু বই আমি বারবার পড়তে চাই, সেগুলোর বেশির ভাগই হয় কবিতার, নয়তো দর্শন ও সাহিত্যতত্ত্ব কিংবা ইতিহাস সংক্রান্ত। যেমন আলবেয়ার কামুর ‘দি মিথ অব সিসিফাস অ্যান্ড আদার এসেজ’ বইটি সেই ১৯৯১ সাল থেকে নেড়েচেড়ে আসছি।
বাংলা ট্রিবিউন : কোন বইটি আপনার জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে? কী করেছিলেন?
চঞ্চল আশরাফ: বই আমার জীবন বিপন্ন করেছে, আমাকে বি্চ্ছিন্ন করেছে অন্যদের থেকে এবং নিজের থেকেও। কিছু বই আছে, যেগুলো নিজের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আত্মধ্বংসী ভাবনা ও ইচ্ছাকে জাগিয়ে তোলে, স্নায়বিক শৃঙ্খলায় আঘাত করে, অন্তর্জগতকে একটা অনির্ণেয় যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে, শুরুর দিকে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়ে মনে হয়েছে আত্মহত্যাই শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা; কামুর ‘আউটসাইডার’ পড়ে মনে হয়েছে, জীবন অনিশ্চিত কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত এবং কোনোটারই মানে নেই; বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ পড়ে মনে হয়েছিল, আশা খুব হাস্যকর নির্বুদ্ধিতা।… ভাবনার এইসব ক্ষমাহীন ফাঁদের মধ্যে আমাকে ফেলে দিয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইগুলো; আত্মহত্যার চিন্তায় মুহ্যমান হয়েছি, প্রেম করতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে বা পিছিয়ে গেছি, ক্লাসরুমে হাজির হতে পারিনি, পারলেও জানালায় তাকিয়ে থেকেছি, পরীক্ষাগুলো ঠিকমতো দেয়া হয়নি, চাকরি-সংসার কিছুই তো সেরকম হয়নি, মানুষের যেরকম হতে দেখি! কিন্তু একেকটি বই একেকটা পৃথিবী, হোক তা ফাঁদ, বারবার এ ফাঁদেই আমি জড়াতে চেয়েছি।
বাংলা ট্রিবিউন : নির্জন দ্বীপে একজনমাত্র লেখকের বই নিয়ে যেতে বললে, কোন লেখককে বেছে নেবেন, কেন?
চঞ্চল আশরাফ: নির্জন দ্বীপে কোনো লেখককে আমি সঙ্গে নিতে চাই না। নির্জনতা রক্ষার জন্য। একে উপভোগের জন্যে। এমনিতেই মস্তিষ্কের মধ্যে অজস্র বই নিয়ে, ঝিল্লির মধ্যে সেগুলোর কম্পন নিয়ে তো যাচ্ছি; যদি সেসব সমুদ্রে ফেলে একেবারে মৌলিক মূর্খের মতো দ্বীপে নামা যেত, ভালো হতো মনে হয়।
বাংলা ট্রিবিউন : বই না পড়ে আপনি বাঁচতে পারবেন কি না? কেন?
চঞ্চল আশরাফ : বই না পড়েও বাঁচা যায়। দেখুন, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন, সিরিয়ার মানুষেরা, শিশুরা কেবল বাঁচারই চেষ্টা করে চলেছে। বই সেখানে তাদের কী সাহায্য করতে পারে? তবে আমি কখনও পরীক্ষা করে দেখিনি, বই না পড়ে থাকতে পারি কি-না। যখন টিভির প্রতিবেদনে, সংবাদপত্রে ক্ষুধা, দারিদ্র্য দেখি, মানুষের বিপন্নতা দেখি তখন বইটই খুব হাস্যকর আর অর্থহীন মনে হয়। নিজেকে মানুষই মনে হয় না। বা, মনে হয়, মরে গেছি।
বাংলা ট্রিবিউন : অন্যকে কোন বইটি পড়ার পরামর্শ দেবেন, কেন?
চঞ্চল আশরাফ: চট করে বলা কঠিন। বা, এটা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির আগ্রহের প্রকৃতির ওপর। যেমন, সে যদি ভালোবাসে কবিতা, বলবো জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ পড়ার জন্য। যদি জানি, এরই মধ্যে বইটি সে পড়েছে, বলবো, আবার পড়ো। বাংলা ভাষা কেন, সারা পৃথিবীর সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই কবিতাগ্রন্থ, যা শুরু হয়েছে এক নিরাশ্রয় মানুষের হাঁটা দিয়ে, শেষও হয়েছে একইভাবে। এক অনির্ণেয় সত্তা সে, তার স্থিতি নেই, তাতে তার আপত্তিও নেই; কিন্তু অন্তর্জগতের যে সংগ্রাম নিয়ে তার চলা, তাও পরিণতিহীন এবং এর বহুমুখী অর্থ ও অর্থহীনতা রয়েছে, সৌন্দর্য রয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন : আপনার লেখা কোন বইটিকে আপনি বেশি গুরুত্ব দেন, কেন?
চঞ্চল আশরাফ: আমার লেখা কোনো বইই গুরুত্বপূর্ণ নয় আমার কাছে। তাছাড়া, আমি মনে করি, প্রকাশের পর লেখক তার বইয়ের ওপর বিবেচনাগত অধিকার হারায়। তখন সে কেউ নয়। পাঠকও নয়। তবে সে পড়ে দেখতে পারে নিজের কোনো বই, গলদগুলো বের করার জন্য, নিজেকে শুধরে নেয়ার জন্য। কিন্তু এরও দরকার আছে বলে মনে হয় না।