ছয় রাগ আর তাদের প্রত্যেকের দুটি করে রাগিনী, অর্থাৎ ছয়রাগ-ছত্রিশ রাগিনী! আগেকার দিনে এইভাবেই রাগ পরিবারের পরিচয় দেওয়া হতো। তবে এ নিয়ে নানা মুনির নানা মতও ছিল। কিন্তু সেসব আলোচনার ভেতরে না গিয়ে আমরা শুধু বলতে পারি যে, রাগগুলির সংখ্যা ছয় এবং তাদের ভাবের কথা চিন্তা করে তাদের ছ’টি ঋতুর প্রতিভূ ধরে নেওয়া যায় অনায়াসেই। মোটামুটি ভাবে, অনেক মতের মধ্যে যে চারটি মতের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বিভিন্ন ঋতুর জন্য নির্দিষ্ট রাগগুলি হলো, গ্রীষ্মে দীপক, বর্ষায় মেঘ, শরতে ভৈরব, হেমন্তে মালকোশ, শীতে শ্রী এবং বসন্তে হিন্দোল।
অন্যান্য রাগের কথা পরে হবে, আগে বলি শরৎ ঋতুর কথা, রবীন্দ্রনাথ যার রাগ হিসেবে ভৈরবীকেই বেছে নিয়েছেন তার গানে, প্রাচীন শাস্ত্রমতে সেখানে ভৈরব রাগটিকেই রাখা হয়েছে। রাগ পরিবারে ভৈরবী হলেন ভৈরবের রাগিনী। ভাবেরও মিল আছে- উভয়েরই ভাবের মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা বৈরাগ্য বা উদাসীনতা। তবু প্রার্থক্যও অনেক। প্রথমে ছোট্ট করে বলে নিই, স্বরের বিচারে ভৈরবীর সব স্বর কোমল এবং মা হলো শুদ্ধ, কিন্তু ভৈরবের ‘রে’ আর ‘ধা’ কোমল, অর্থাৎ ‘ঋ’ আর ‘দা’ এবং ‘গা’ ও ‘নি’ হলো শুদ্ধ। ফলে ভৈরবের রূপ ভৈরবীর থেকে আবার অনেকটাই পৃথক। ভৈরব অতি গম্ভীর এবং প্রশান্ত প্রকৃতির রাগ। ভৈরব অর্থাৎ শিবের মতোই সে বৈরাগী। তবু সেও আমাদের সবারই পরিচিত।
প্রথমেই বলব, রবীন্দ্রনাথের সেই বহু পরিচিত গানটির কথা ‘মন জাগ মঙ্গল লোকে’। বিশুদ্ধ ভৈরবের রূপটি এতে পাবেন। আর গানটির বাণী আপনাকে বলে দেবে, সময়টা ভোর বেলা, জাগরণের সময় যখন দু’চোখ অমল অমৃতময় নবআলোয় ভরে ওঠে, তখনই। সদ্য সূর্যোদয় হচ্ছে এবং তখনো তার আলো প্রখর হয়ে ওঠেনি, সেই সময়। কিন্তু ভৈরবী সকালের রাগ।
‘মন জাগ মঙ্গল লোকে’, গানটি রবীন্দ্রনাথের ভাঙাগান পর্যায়ের। মূল গানটি একটি খেয়াল গান- ‘তুম জাগে মোহন প্যারে’। লক্ষ্য করুন, এই গানটির বাণীও ভোরের। শ্রীকৃষ্ণ ঘুমিয়ে আছেন আর তাকে জাগানো হচ্ছে। ‘মোহন প্যারে, তুমি জাগ’। গোচারণে যাবার সময় হয়ে গেল, অন্য সব গোপ বালকরা তোমার জন্য প্রতীক্ষা করছে।
লক্ষ্য করুন, দুটি গীতি কবিতার আঙ্গিক এবং শব্দচয়নেও কত মিল! সুরও হুবহু এক, শুধু ভঙ্গিমার পার্থক্য! একটি ত্রিতালে নিবদ্ধ দ্রুত খেয়াল এবং অন্যটিও ত্রিতালেই বাঁধা, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সেখানেই সবচাইতে বড় তফাৎ। খেয়ালের যে বাণী তা একবারই উচ্চারিত হওয়ার পরে সুর তার আপন খেয়ালে চলে। সে তখন অনন্তের জীব, কোনো বাঁধা ধরা পথে নয়, সে তখন মুক্ত; তার মধ্যে থেকে রাগের প্রকৃত রূপটাকে প্রত্যক্ষ করার দৃষ্টি আমাদের মতো অগণিত সাধারণ শ্রোতার আয়ত্তে নয়। আমরা চাই সংক্ষিপ্ত অবয়বে রাগটির একটি রূপরেখা যা সহজ বলেই সহজে মনে রাখা যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরটা মনে বসে গেলে, তখন খেয়ালে, যাকে বলে রাগের বিস্তার, সেটা অনুসরণ করা সহজ হবে।
অতএব প্রথমে রবীন্দ্রসঙ্গীতটি শুনুন, তারপর খেয়াল।
‘তুম জাগো মোহন প্যারে’-গানটির দু’টি রেকর্ডের কথা আমার মনে পড়ছে। প্রথমটির শিল্পী পন্ডিত নারায়ণ রাও ব্যাস এবং অন্যটি জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গাওয়া। গান দুটি প্রায় একই ধাঁচে গাওয়া এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতটির সঙ্গে এর মিলও সহজেই খুঁজে পাবেন। এই খেয়াল গানটির প্রসঙ্গে একটি রাগ-প্রধান বাংলা গানের কথাও মনে পড়ছে। গানটির কথা হলো, ‘চির সুন্দর নাওল কিশোর’। খুব নিশ্চিত নই, লেখক সম্ভবত তুলসী লাহিড়ী এবং গায়ক জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, রাগ ভৈরব এবং এটিও ওই মূল খেয়াল গানটিরই অনুসরণে রচিত, কিন্তু এটিও আসলে খেয়াল গানই, শুধু ভাষাটাই বাংলা; অর্থাৎ যাকে রাগ-প্রধান বাংলা গান বলে, তাই।
এই রকম বহু রাগ-প্রধান বাংলা গান এককালে, প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও বাঙালির কাছে খুব প্রিয় ছিল। বিশেষত, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গান, যা জ্ঞান-গোঁসাইয়ের গান বলেই বেশি পরিচিত ছিল। তিনি ছাড়াও ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কিছু রাগ-প্রধান বাংলা গান, কিংবা তারাপদ চক্রবর্তীর গানেরও খুবই জনপ্রিয়তা ছিল এবং সেসব রেকর্ড বাংলার ঘরে ঘরেই দেখা যেত। তারপর কী যে হলো!…
থাক। সেসব কথা বরং থাক। আমরা জানি, নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি যে বাংলা গানের এই অবক্ষয়ের অবসান একদিন হবেই। সুর ও বাণীর এই উৎকট, এই ক্লান্তিকর একঘেঁয়েমি একদিন চিরন্তন বাণী আর চিরকালের সুরের স্পর্শে কেটে যাবে নিশ্চিতভাবেই। সঙ্গীতের কাছ থেকে আপনি যা পেতে পারেন তা উৎকট স্মার্টনেস-এর থেকে অনেক বড়। সে আপনাকে আনন্দ দিতে পারে। তার কাছে এসব তুচ্ছ জিনিস নয়, আনন্দই প্রত্যাশা করুন। আপনার মতোই যখন একে একে অনেকেই প্রকৃত সঙ্গীতের সেই আনন্দকে আগে আস্বাদন করবেন, তখন সঙ্গীতের নামে এই কোলাহল আপনিই বন্ধ হবে, উঠে আসবে আগামী দিনের প্রকৃত বাংলা গান। মনে রাখা দরকার, প্রকৃত শিল্প চিরকালই নতুন, কিন্তু যা কিছু নতুন, তাই যে শিল্প হয়ে উঠবে- এমন কোনো কথা নেই। শিল্পের সবচাইতে বড় লক্ষণ তারই সৌন্দর্য। যা অসুন্দর তা আর যাই হোক, শিল্প নয়, সঙ্গীত নয়। অবশ্য সুন্দর কাকে বলব, এ প্রশ্ন তুলতে পারেন কেউ কেউ। বলবেন, এ বিষয়ে একটা সার্বজনীন ঐকমত্য কিভাবে সম্ভব হতে পারে? সে কথা ঠিক। সেটা হয়তো কোনো দিনই সম্ভব হবে না; কিন্তু তবু, ‘সুন্দর’ শব্দটা আমরা ব্যবহার করি এবং আমরা এমন বহু মানুষই আছি যারা গোলাপকে ‘সুন্দর’ বলি নির্দ্বিধায়। সেক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ হয় না। আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তের গানকেও সুন্দর বলি একমত হয়েই। রামপ্রসাদী, লালনগীতিকেও তাই বলি। কাজেই, সৌন্দর্য বলতে আমরা যা বোঝাতে চাই, তা আমরা জানি। সেই একই সৌন্দর্যকে আমরা প্রত্যক্ষ করি রাগ রাগিণীর মধ্যেও! যা আমাদের ভালো লাগে, যা আমাদের আনন্দ দেয় তাকে ছেড়ে এমন কিছুর প্রতি আমরা প্রলুব্ধ হব কেন, যা অগভীর, নিরানন্দ? শুধু নতুনত্বের আকর্ষণে? কই, নতুন বলে তো আমরা কখনো রসগোল্লায় নুন মাখিয়ে খাই না! …
আসলে একটি সমাজে কোন বিষয়টির বেশি প্রসার বা উন্মেষ ঘটবে, সেটা নির্ভর করছে সেই সমাজ কোন বিষয়ের প্রতি কতটা সপ্রশংস, তার ওপরে। কথাটি বলেছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। কথাটি অনেকাংশেই সত্য, তাতে সন্দেহ নেই। সঙ্গীতের বদলে মানুষ কোলাহলই পছন্দ করেছে, তাই ধীরে ধীরে সঙ্গীতের বদলে কোলাহল প্রকাশের পথ প্রশস্ত হয়েছে। আমরা যদি প্রকৃত সঙ্গীতের প্রশংসা করি, যদি প্রকৃত সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত হই তবে ধীরে ধীরে তারই বিকাশ হবে এবং কোলাহল কমে যাবে! আর সেটা শুধু সঙ্গীত বা ওস্তাদদেরই আনন্দের কারণ হবে তা নয়, আমাদের আনন্দও নিশ্চিতভাবেই আসবে।
সুতরাং, সেই গান শুনুন যা গভীর, যা সুন্দর, যা আপনাকে আনন্দ দিতে পারে। তারই প্রশংসা করুন। অবশ্যই এ প্রশংসা তখনই স্বতঃস্ফূর্ত হবে যখন সেই গানের আস্বাদন লাভ করতে পারব। সৌভাগ্যবশত আমাদের এত অবহেলা সহ্য করেও, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং বাংলা গানের যে বিপুল সম্পদ আজও অবশিষ্ট আছে, তার জন্য এডিসন সাহেবের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আর সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞতা ইন্টারনেটের প্রতিও। কৃতজ্ঞতা আরো বিশেষভাবে ‘ইউটিউব’-এর প্রতি। সে এক অমূল্য রত্ন ভাণ্ডার। সে ভাণ্ডারের দরজা সবার কাছেই অবারিত। প্রাণ ভরে গান শুনুন, রাগকে চিনুন চেনা সুরের মধ্যে দিয়ে! সে সব দিন হারিয়ে গেলেও, সে সব গানের অনেকটাই এখনও আছে। অবশ্যই গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সি.ডি. সেখান থেকে আরো আধুনিক প্রক্রিয়ায় সে সবই আছে। আছেন, ওস্তাদ মৌজুদ্দীন খাঁ, কালে খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, আছে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর সরোদ, বেহালা, এনায়েৎ খাঁর সেতার, সুরবাহার, আলী আকবর খাঁর সরোদ, পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার, আর বাংলা গানের ইন্দুবালা, কমলা করিয়া, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ মল্লিক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী এবং জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী…
হ্যাঁ, ভৈরবের কথা বলতে গেলে তার কথা বারবারই ফিরে আসবে। তার গাওয়া অন্তত তিনটি গানের কথা না বললেই নয়। একটি খেয়াল এবং একটি বাংলা গানের কথা আগেই বলেছি এবং তৃতীয়টি হলো একটি অবিস্মরণীয় নজরুলগীতি : ‘জয় বিগলিত-করুণা রূপিনী গঙ্গে’। ভৈরবের গাম্ভীর্য এই গানটিতে যেমন ফুটেছে, তা আর কোনো বাংলা গানে পাইনি। তবে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গানের কথাও এই সঙ্গে মনে পড়ছে- ‘জাগ আলশশয়নবিলগ্ন’ কিন্তু গানটি মূলত ভৈরব রাগে হলেও এতে পরজ নামে আরেকটি রাগও মিশ্রিত হয়েছে। পরজের কথা পরে; আপাতত শুধু এটুকুই বলার যে ওই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি বিশুদ্ধ ভৈরব নয়।
বিশুদ্ধ ভৈরবের যে ভাব-রূপ সে রূপ হলো ধ্যানমগ্ন মহাদেবের রূপ। ভৈরব অর্থাৎ মহাদেবের জটার মধ্যে দিয়ে অজস্রধারায় গঙ্গাবতরণের ধ্বনিই এই রাগের অভিব্যক্তি। এ কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হলে ওস্তাদ এনায়েৎ খাঁর সুর বাহারে ভৈরব রাগের আলাপ ও কালা আপনাকে অবশ্যই শুনতে হবে। আলাপ এবং কালা এই দুই পর্বই অনিবদ্ধ অর্থাৎ বৈতালিক। এতে কোনো তাল থাকে না, কোনো তালবাদ্যও বাজে না, কিন্তু তবু তারও মধ্যে একটা সুনির্দিষ্ট গতি থাকে, যা ব্যক্ত হয় ধ্বনির ওঠানামার মধ্যে দিয়ে। এই গতিকে বলে লয়। তন্ত্রীবাদ্যে তার যত দ্রুত বাজানো হবে, অথবা কণ্ঠ সঙ্গীত বা বাঁশি বা এস্রাজের মতো যন্ত্রে সুরের ওঠানামার মধ্যে দিয়েই লয়ের প্রকাশ ঘটে। আরো একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। এনায়েৎ খাঁর সুর বাহারে ভৈরব রাগটি শুনুন। খেয়াল করুন, তন্ত্রীর প্রতিটি টুং…টুং শব্দের মধ্যে সময়ের মোটামুটি নির্দিষ্ট একটা ব্যবধান আছে এবং ক্রমশই এই ব্যবধান কমতে থাকছে, আমরা বলব, ক্রমশই লয় বাড়ছে। আলাপ শেষ হয়ে গেল, কালা অংশে যন্ত্রটি আরো দ্রুত বাজতে থাকবে অর্থাৎ লয় তখন আরো দ্রুত … মনে হবে প্রবল স্রোতস্বিনী গঙ্গার নিরবচ্ছিন্ন জলপ্রবাহ যেন মহাদেবের জঠার মধ্যে থেকে নির্গত হলো শত সহস্র ধারায়।
সেই অনন্ত গম্ভীর প্রবাহের ধ্বনিই রাগ ভৈরব।