ক্লাসিক্যাল অটিজম বা অটিজম হলো মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুবিক বিকাশ ব্যাহত জনিত সমস্যা। বিশ্বে প্রতি ১০০ শিশুতে একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশু পাওয়া যায়। অটিজম এর পুরো নাম ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসওর্ডার’। সংক্ষেপে এ এস ডি (ASD) বা ক্লাসিক্যাল অটিজম বলে। অটিস্টিক শিশুদের আচার-আচরণে নানান বৈচিত্রের সমাহার থাকে, সেজন্যেই এর নাম “অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসওর্ডার”।
সম্প্রতি আমেরিকান নিউরো-সাইকিয়াট্রিস্টদের গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের দেশে প্রায় ৬৮ শিশুতে একজনের অটিজমের বৈশিষ্ট্য আছে। এখন পর্যন্ত ব্রেইনের এই ডিসওর্ডার এর নির্দিষ্ট কোন কারণ জানা যায়নি, তবে ধরা হয় জেনেটিক্স এর জন্যে বহুলাংশে দায়ী। তবে মদ বা মাদকাসক্তি, গর্ভাবস্থায় মায়েদের কিছু রোগ, তাদের অযত্ন অবহেলা এবং গর্ভাবস্থায় কিছু ড্রাগ যেমন, ভেলপ্রোয়িক এসিড যা “মূড ডিসওর্ডার” বা “মৃগীরোগে” ব্যবহৃত হয়, তার ব্যবহার থেকে এটি হতে পারে। মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলেদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অনুপাতিক হারে যা ১:৫।
যেহেতু এটা স্নায়ুবিক বিকাশ ব্যাহত জনিত সমস্যা, তাই এর লক্ষণগুলোও ব্রেইনের কাজকর্মের সাথে সর্ম্পর্কিত। আমাদের দৈনন্দিন চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার ব্যবহার ইত্যাদি সবগুলোর মূল নিয়ন্ত্রক হলো আমাদের দেড় কেজি ওজনের ব্রেইন।
সাধারণত ৩ বছর বয়সে একটা মানব শিশুর ব্রেইন দৈনন্দিন সকল কাজগুলোকে পুরোপুরি রপ্ত করে নেয়। তাই বলা যায়, তিন বছর বয়সেই অটিজমের লক্ষণগুলো পুরোপুরিভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়।
বয়স অনুযায়ী অটিজমের বৈশিষ্ট্য
একটি শিশুর মাইলস্টোন অব ডেভেলপমেন্ট বা মাস, বছর অনুপাতে শিশুর স্নায়বিক বিকাশ বিবেচনা করলে ধাপে ধাপে যে সকল উপসর্গ একটা অটিস্টিক শিশুর মধ্যে দেখা যেতে পারে, তার তুলনামূলক একটি ধারণা নীচে দেয়া হলো।
৩ মাস বয়সে
(এসময় ডায়াগনোসিস কেবল সাইকিয়াট্রিস্ট করতে পারেন)
মা বা বাবার মুখটির সাথে পরিচিত থাকবেনা, দেখলে হাসবেনা।
শব্দের বা আলোর উৎসের দিকে তাকাবে না, প্রতিক্রিয়া করবে না।
চলমান খেলনা বা বস্তুর প্রতি মনযোগী হবেনা, ধরতে চাইবে না, নাড়াচাড়া করবেনা।
“ব-ব” “ত-ত” শব্দগুলো করবে না।
#৭_৮_মাস বয়সে যা দেখা যেতে পারেঃ
শিশু হাসবেনা, কারো সাথে খেলবে না, খেলা উপভোগ করবে না,উষ্ণ সম্পর্ক হবে না।
হাতের নাগালের বাইরের খেলনা হাত বাড়িয়ে আনতে চেষ্টা করবে না, আগ্রহ দেখাবে না।
শব্দ করলে শব্দের উৎসের দিকে তাকাবেনা।
মা বা বাবার মুখের প্রতি আলাদা কোন আকর্ষণ দেখাবে না, আইডেন্টিফাই করতে পারবেনা।
ঘাড় শক্ত করে, সাপোর্ট সহ বা সাপোর্ট ছাড়া বাছানায় বসবেনা।
নাম ধরে ডাকলে তাকাবে না।
“অপছন্দ” বা “না” জিনিষ টি বুঝাতে পারবে না
উপুড় করে শোয়ালে চিৎ হবেনা। (সাধারণত এ বয়সে এটা করে)
হাত পা ছুড়াছুড়ি, নাড়াচাড়া করা, শব্দ করা, হাসি কান্না ইত্যাদি দ্বারা মনোযোগ আকর্ষণ করবেনা।
১ বছর বয়সে
অপরিচিত কাউকে দেখলে লজ্জা বা ভয় পাবে না।
মা বাবার কাছ থেকে সরালে কাঁদবে না।
‘না’বললে সেটা বুঝবেনা বা মানবে না।
শব্দ অনুকরণ করতে পারবেনা বা করবে না।
আঙুল মুখে নিয়ে চুষবে না।
“দাদা” “মামা” “নানা” “তাতা” ইত্যাদি পরিচিত শব্দ বলবেনা বা বলতে পারবে না।
সাপোর্ট নিয়ে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারবে না।
হামাগুড়ি দিয়ে আগ্রহী কিছুর দিকে আগাবে না।
পেয়ালা বা গ্লাস আকৃতির কিছু দিলে তা মুখের কাছে নিয়ে পানি খাবার মতো চেষ্টা করবে না,
মোবাইলে শব্দ করলে তা ধরবে না, ধরে নিয়ে মুখে বা কানে দিবে না। (অনুকরণ)
খেলনা বক্স বা জার থেকে খেলনা বের করতে বা ঢুকাতে পারবে না।
আগ্রহী খেলনা বা বস্তুর পেতে তার দিকে চোখ বা আংগুল দিয়ে নির্দেশ করবে না।
নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেবে না।
বিপদে পড়লে বা কষ্ট পেলে সাহায্য নিবে না।
কোন অর্থপুর্ণ অঙ্গ ভঙ্গি করবে না। যেমন মাথা দোলানো, হাত নেড়ে টা-টা দেয়া, ইত্যাদি।
আগ্রহের খেলনা বা বস্তু কাপড় বা কাগজ দিয়ে তার সামনে লুকালে তা খোঁজে বের করতে পারবেনা।
অহ, আহ,অফ, হু, ইত্যাদি শব্দ দিয়ে কিছু বুঝাতে পারবেনা অথবা এসব শব্দ অনুকরণ করবেনা।
২বছর বয়সে
হাঁটবে না। দৌঁড়াবেনা আর তা করলেও উদ্দেশ্যহীন, অগোছালো ।
সমবয়সী শিশু দেখলে রোমাঞ্চিত হবেনা, বা মিশবে না।
“পছন্দ” “অপছন্দ” বুঝাতে পারবে না।
“লাল” “নীল” “সবুজ” বা বিভিন্ন রঙ বা এর ছবি আলাদা করে বুঝাতে পারবে না।
কিছু দেখিয়ে দিলে অনুকরণ করবে না।
খেলনা বা কোন বস্তু পিছনে টেনে টেনে নিয়ে যাবে না বা সামনের দিকে ঠেলে যাবে না।
অতি সাধারন বিষয়ে “হা” বা “না” নির্দেশনাবলী মান্য করবে না, বুঝবে না।
৩ বছর বয়সে
শিশু আগ্রহ, অনাগ্রহ কিছুই বুঝাবে না বা বুঝাতে পারবে না।
“আমি” বা “আমার” এটা বুঝাতে পারবে না।
কথাবার্তা অস্পষ্ট থাকবে।
হঠাৎ একেবারেই অর্থহীন শব্দ বলবে।
জিজ্ঞেস করলে নাম, বয়স বলতে পারবে না।
শিশুদের সাথে মিশবে না, খেলবে না। খেললেও তা শিখিয়ে দেয়ার মতো না, হয়ত অদ্ভুত রকম খেলবে।
অন্যকে আঘাত করে বসবে বা নিজেকেও আঘাত করতে থাকবে।
চোখে চোখ রেখে কথা বলবে না।
সিঁড়ি দিয়ে এক পা দু’পা ওঠা নামা করতে পারবে না।
অপরিচিত কাউকে গ্রাহ্য করবে না।
রঙ দিয়ে আঁকাজোকা করবে না।
তবে তিন বছরের এসকল মাইলস্টোন অব ডেভেলপমেন্ট এর অসামঞ্জস্য পর্যবেক্ষণ করে করে বিশেষজ্ঞ ছাড়া সাধারণ কারো কাছে অটিজম ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া অনেকটাই কঠিন। কারন অনেক সময় বয়সের সাথে সাথে বেড়ে উঠার মধ্যে যে অসামঞ্জস্য থাকে, তা আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সময়ের হের ফের হয়, এমন কি কখনো কখনো ঠিকও হয়ে যায়।
আবার এমনও হয় জন্ম থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বেড়ে উঠায় তেমন কোন ত্রুটি হয়তো প্রথমে দেখা যায়না, কিন্তু পরবর্তীতে হঠাৎ করে বিকাশ ব্যাহত দেখা দেয় ফলে ধীরে ধীরে তার পক্ষে স্বাভাবিক ভাবে আর চলাফেরা বা মেলামেশা সম্ভব হয় না।
শিশুর মাইলস্টোন অব ডেভেলপমেন্ট এর ধাপে ধাপে পাওয়া লক্ষন বিবেচনা না করে যদি সামগ্রিকভাবে তিন বছর বয়েসী একটি অটিস্টিক শিশুর র লক্ষন গুলো খেয়াল করা হয় তবে দেখা যাবে অটিস্টিক বেবি,
“সারাক্ষণ আনমনা থাকে। আপন জগতে বিচরণ করে। আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। কারনে বা অকারনে চরম ক্ষিপ্ত হয়। নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা। দেখিয়ে দেওয়া কিছুতে বেশি মনযোগী হয় না, আবার কখনো কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা নিজে থেকে অর্থহীন কাজ মগ্ন থাকে। ডাকলে সাড়া দেয় না। জিজ্ঞেস করলে নিজের নাম বলবে না। চোখে চোখ রেখে কথা বলবেনা। হাত পা অদ্ভুত ভাবে নাড়াবে, প্যাচাবে। আঘাত পেলে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললে সে শুনবে না। ধরতে গেলে বা জড়িয়ে ধরলে হয়ত বাধা দেবে। একা থাকতে চাইবে। বারবার একই শব্দ বা অদ্ভুত শব্দ ও বাক্য মুখ দিয়ে করবে। আশেপাশের কারো প্রতি বা কিছুর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। রুটিন মেনে চলতে পারবে না। অর্থহীন কিছুতে অনেক সময় অস্বাভাবিক আকর্ষণ দেখাবে। বিনা কারণে নিয়ত মেজাজ পাল্টাবে অত্যাধিক হাসি বা কান্নার মাধ্যমে। দৈনন্দিন চলাফেরায় যে কোন পরিবর্তন তার মাঝে প্রচণ্ড জেদ তৈরি করবে। নিজেকে বা অন্যকে অকারণে আঘাত করবে। বিপদ শংকা বুঝবে না এবং সাহায্য চাইবে না।
অটিজম প্রতিরোধে করণীয়
অটিজম যেহেতু স্নায়ুবিক বিকাশ ব্যাহত জনিত সমস্যা সচেতনতার মাধ্যমেই এটি প্রতিরোধ করতে হবে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে নানান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
পরিবারে কারো স্নায়ুবিক বিকাশ জনিত সমস্যা বা অটিজম অথবা কোন মানসিক ও আচরণগত সমস্যা থাকলে, পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজমের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত গর্ভধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা না করা, পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, শিশুর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
১. গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস স্নায়ুবিক বিকাশের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই ওই সময়ে যথাযথ বিশ্রাম, আহার এবং এন্টিনেটাল কেয়ার নেয়া। এ সেবা সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন। এমনকি সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ সেবা নিশ্চিত করেন।
২. বেশি বয়সে বাচ্চা না নেওয়া।
৩. বাচ্চা নেয়ার আগে মাকে রুবেলা ভেকসিন দিতে হবে।
৪. গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ না খাওয়া।
৫. গর্ভাবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া ন্যূনতম চারবার চেকআপে আসা।
৬. মায়ের ধূমপান, বা মায়ের সামনে বা শিশুর সামনে ধূমপান (যা অত্যধিক খারাপ), মদ্যপান, ইয়াবা গ্রহন, গাঁজা নেয়া বা এজাতীয় কোন অভ্যাস থাকলে বাচ্চা নেয়ার আগে পরে অবশ্যই তা ছেড়ে দিতে হবে।
৭. বাচ্চাকে প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ এবং পরবর্তীতে পূর্ণ দুই বৎসর বুকের দুধের পাশাপাশি সুষম খাবার খাওয়াতে হবে।
লেখক: ডা. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট