যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশী প্রথম পছন্দ । এ স্বপ্ন ছুঁতে প্রতি বছর দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী। এর মধ্যে আইনানুগ অভিবাসনের পাশাপাশি অনেকে আইনত নিষিদ্ধ বা অবৈধ উপায়ে দেশটিতে প্রবেশ করছে।যুক্তরাষ্ট্রে এমন অবৈধ প্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে আট বছরে মেক্সিকোয় কারাবরণ করেছে আড়াই হাজারের বেশি বাংলাদেশী। আর যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ প্রবেশের পর গ্রেফতার হওয়া এবং ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার কারণে এ সময়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে ১ হাজার ৭৩১ বাংলাদেশীকে। ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেসের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭৩১ বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৩১০ জন, ২০১০ সালে ২৮১, ২০১১ সালে ২৪৮, ২০১২ সালে ২৩৮, ২০১৩ সালে ১৬৭, ২০১৪ সালে ১৬৯, ২০১৫ সালে ১৯৯ ও ২০১৬ সালে ১৯৯ জন বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানো হয়। এ সময়ে মোট ৯৭৫ বাংলাদেশীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৯ সালে ৯৪ জন, ২০১০ সালে ৭০, ২০১১ সালে ৬৯, ২০১২ সালে ৮৬, ২০১৩ সালে ১০৬, ২০১৪ সালে ১৮৯, ২০১৫ সালে ২২২ ও ২০১৬ সালে ১৩৭ জন বাংলাদেশীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে দেশটি। আর ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনসিদ্ধ উপায়ে স্থায়ী অধিবাসী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে ১৪ হাজার ৬৮৭ জন বাংলাদেশী। এর মধ্যে নতুন আবেদনকারী ১৩ হাজার ১৫১ জন। আর পূর্ণ মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছে ৮ হাজার ৫০৫ জন বাংলাদেশী।
অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশীদের প্রথমে আকাশপথে দুবাই, ইস্তাম্বুল অথবা তেহরান নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাদের নেয়া হয় ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া অথবা স্প্যানিশ গায়ানায়। এরপর ব্রাজিল-কলম্বিয়া-পানামা-কোস্টারিকা-নিকারাগুয়া-এল সালভাদর-গুয়াতেমালা হয়ে তাদের পৌঁছে দেয়া হয় মেক্সিকোয়। পরবর্তী সময়ে সুযোগ বুঝে মেক্সিকো থেকে সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা চালায় অভিবাসন প্রত্যাশীরা। মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা এ দুর্গম পথে তাদের নিয়ে যায়।
জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ এ পন্থায় যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর খরচ হিসেবে জনপ্রতি আদায় করা হয় ২৫-৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত। অভিবাসন প্রত্যাশীদের কখনো কখনো ১০-১২টি দেশ পার হতে হয়। পুরো পথ পাড়ি দিতে হয় সড়কপথে অথবা হেঁটে। দুর্গম ও বিপদসংকুল পথে প্রাণও হারায় অনেকে। যারা বেঁচে যায় তাদের ঠিকানা হয় ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, পানামা অথবা মেক্সিকোর বন্দিশালায়। বিশেষ করে মেক্সিকোর কারাগারে বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিতে শুরু করে। গোড়াতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের পাশাপাশি শিক্ষাগত কারণে কিছু মানুষ
সে দেশে যাওয়ার সুযোগ পায়। এরপর ১৯৯০ সালের দিকে ডাইভারসিটি ভিসা বা ডিভি লটারির বরাতে অনেকে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পায়। ডিভি লটারি প্রোগ্রামের আওতায় গ্রিন কার্ড ও মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছে অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের দিকে দেশটিতে বাংলাদেশী জনসংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮০০। ২০০০ সালের দিকে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৪১২ জনে। সর্বশেষ ২০১০ সালে এসে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩০০ জনে।
ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির গবেষণা অনুযায়ী, ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশী ১৪৯ বাংলাদেশী মেক্সিকোয় আটক হয়। ২০১২ সালে আটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৭ জনে। পরের বছর থেকে মেক্সিকোর কারাগারগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পথে যাওয়ার দায়ে আটক অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ২০১৩ সালে আটক হয়েছিল ৩২৮ জন, ২০১৪ সালে ৬৯০, ২০১৫ সালে ৬৪৮ ও ২০১৬ সালে ৬৯৭ জন। ২০১৭ সালে এখন পর্যন্ত ১২০ জন আটক হওয়ার কথা জানা গেছে। তারা সবাই বর্তমানে মেক্সিকোর জেলে বন্দিদশা পার করছে।
স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে মেক্সিকোর জাতীয় অভিবাসন সংস্থা আইএনএমের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বৈঠকও করেন। বৈঠকে এ নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে আইএনএম। বৈঠকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়া থেকে মেক্সিকোয় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এসব অভিবাসীর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশী রয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য হলো সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিবাসন প্রত্যাশীদের যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে পাচারকারীরা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে মরুভূমি, পাহাড় কিংবা জঙ্গল পথ বেছে নেয়। কারণ এসব স্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম। দুর্গম এসব পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে অনেকেই। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালের পর থেকে শুধু মেক্সিকোর সীমান্ত এলাকাতেই ছয় হাজারের বেশি মরদেহ উদ্ধার করেছে মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী।