পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস। সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে প্রায় তিন মাস চিকিৎসা নেয়ার পরে গতকাল দুপুরে সিআরপির উদ্যোগে রেডওয়ে হলে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন খাদিজা। এ সময় খাদিজা বলেন, আমি সাভারে সিআরপিতে চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম হুইল চেয়ারে বসে। তখন আমি হাঁটতে পারতাম না, ঠিকমতো কথা বলতে পারতাম না, ধীরে ধীরে কথা বলতাম, হাত দিয়ে কোন কাজ করতে পারতাম না। সিআরপির তিন মাসের চিকিৎসায় প্রায় সুস্থ হয়ে এখন আমি নিজের কাজগুলো নিজেই করতে পারি। তার স্বপ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে খাদিজা বলেন, বাড়িতে ফিরে নিজের অসমাপ্ত পড়ালেখা শেষ করে ব্যাংকার হতে চান তিনি। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতার পাশাপাশি দেশবাসীর নিকট দোয়া প্রার্থনা করেছেন। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে শুক্রবার অথবা শনিবার খাদিজা সিআরপি থেকে সিলেটে তার নিজ বাড়িতে চলে যাবেন। এ সময় তিনি ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের বিচারও দাবি করেন। সংবাদ সম্মেলনে খাদিজার চিকিৎসক ডা. সাঈদ উদ্দিন হেলালসহ সিআরপির ঊধর্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ডা. সাইদ বলেন, খাদিজা গত ৩০শে নভেম্বর সিআরপিতে ভর্তি হয়। তখন আট সদস্য বিশিষ্ট টিম গঠনের মাধ্যমে তার চিকিৎসা শুরু হয়। বিভিন্ন থেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সময় তার সিটি স্ক্যান ও বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার জন্য তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেও পাঠানো হয়। দীর্ঘ তিন মাসের চিকিৎসার পর তিনি এখন তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। মেডিকেল সার্ভিসেস উইং রেজিট্রার ডাঃ ইসরাত জাহান ঊর্মি বলেন, প্রাথমিকভাবে সিআরপি-তে আসার পর আমরা খাদিজার কিছু পরীক্ষা করি। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে এবং টেন্ডন ইঞ্জুরির কারণে তার বাম পাশ নিষ্ক্রিয় ছিল। বর্তমানে তার আর কোন সার্জারি প্রয়োজন নেই, তিনি এখন সুস্থ আছেন এবং তিনি সক্রিয়ভাবে নিজের সব কাজ করতে পারছেন। তার কোন খিচুনি নেই এবং বর্তমানে তার যৎসামান্য কিছু ওষুধ চলছে। সিআরপি’র নিউরোলজি বিভাগের ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট সুলক্ষণা শ্যামা বিশ্বাস বলেন, খাদিজাকে শুরুতে পর্যবেক্ষণ করে আমরা তার মূলত হেড ইনজুরি ও বাম হাতের টেন্ডন ইনজুরি ছিল। এছাড়াও তার আরো যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো হলো- বাম কাঁধের ব্যথা, বাম পাশের কাঁধ, আঙ্গুল, হিপ ও গোড়ালির সীমিত নড়াচড়া এবং তার আঘাতপ্রাপ্ত পাশের টোন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। তার ভারসাম্যের স্কোর ছিল ৫৬ এর মধ্যে ১৩, যার ফলে সে চলাফেরার জন্য হুইল চেয়ারের উপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়াও তার ট্রানজিশনাল মুভমেন্ট (বিছানায় এক কাত থেকে অপর কাত হওয়া, শোয়া থেকে বসা, বসা থেকে দাঁড়ানো), হাঁটা এসব কিছুর জন্য সে পরিবারের উপর নির্ভরশীল ছিল। তিন মাসের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান সমপন্ন করার পর বর্তমানে তার কাঁধে কোন ব্যথা নেই, বাম পাশের প্রত্যেক জয়েন্টের মুভমেন্ট বেড়েছে। তার ভারসাম্যের স্কোর ১৩ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৪৫ এ দাঁড়িয়েছে যার অর্থ সে সমপূর্ণ স্বাধীনভাবে চলাচলে সক্ষম। আমাদের ফিজিওথেরাপি বিভাগের পরবর্তী পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি আমাদের ফলোআপে থাকবেন। বর্তমান অবস্থার আলোকে আমরা আশা করছি খাদিজা তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিভাগের ক্লিনিক্যাল স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট তাহমিনা সুলতানা বলেন, খাদিজাকে শুরুতে যখন পরীক্ষা করা হয় তখন তার মুখের মাংসপেশিতে, জিহ্বা নড়াচড়াতে দুর্বলতা ছিল যে কারণে তার কথায় জড়তা ছিল এবং কণ্ঠস্বর নিচু থাকার কারণে কথা ধীরে শোনা যেত। এছাড়াও খাদিজার অন্যের কথা বুঝতে সমস্যা হতো, স্মৃতিশক্তি কমে গিয়েছিল, মনোযোগে সমস্যা ছিল। বুদ্ধিমত্তার কার্যক্রমগুলো যেমন- কোনো সমস্যার সমাধান করা, ক্যালকুলেশন করা, ভালো-মন্দ পার্থক্য করা, কোনো কাজের ধাপসমূহ বর্ণনা করা, কোনো ঘটনা গুছিয়ে বলাতে সমস্যা ছিল। নিয়মিত থেরাপি নেয়ার পর বর্তমানে খাদিজা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে, অন্যের কথা ভালোভাবে বুঝতে পারে, তার স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। তিনি এখন গুছিয়ে কথা বলা, যেকোনো সমস্যার বিভিন্ন ধরনের সমাধান বলা, ক্যালকুলেশন করা, যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া, ভালো-মন্দ পার্থক্য করা- এ কাজগুলো খুব ভালোভাবে করতে পারেন। তার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে আমরা আশা করছি তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। অকুপেশনাল থেরাপি বিভাগের ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপিস্ট মানসুরা আক্তার বলেন, খাদিজা আমাদের কাছে যেসব সমস্যা নিয়ে আসছিলেন তা হচ্ছে শরীরের বাম পাশটা দুর্বল থাকার কারণে সে তা ব্যবহার করতে পারতো না। তার দৈনন্দিন জীবনের কাজ যেমন খাওয়া-দাওয়া করা, ব্রাশ করা, চুল আচড়ানো, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলাফেরা করা, লেখাপড়া করা, সামাজিকতা ইত্যাদি সে নিজে নিজে কিছুই করতে পারত না। এছাড়াও এসব কাজের জন্য সে অন্যের উপর ১০০ ভাগ নির্ভর ছিল। এই সমস্যার আলোকে আমরা তার জন্য স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা পরিকল্পনা করি এবং সে অনুযায়ী তাকে বিভিন্ন রকম সিমুলেটেড কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করানো হয়। অকুপেশনাল থেরাপির বিভিন্ন চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় তিন মাসের মধ্যে খাদিজা এখন তার দৈনন্দিন জীবনের সব কাজেই প্রায় ১০০ ভাগ স্বনির্ভর। আমরা মনে করছি খাদিজা এখন তার প্রধান লক্ষ্য কলেজে যাওয়া ও পড়াশোনা করার জন্য অর্থাৎ তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সিআরপি’র কাউন্সেলর মো. আবদুল জব্বার ও খাদিজা আক্তার বলেন, বর্তমানে তার মানসিক অবস্থা খুবই ভালো। তিনি বাস্তবকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী। ঘটনা প্রবাহে সব ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ নির্বিঘ্নে স্মরণ করা, ভিডিও দেখা, ঘটনাকে অন্যের নিকট বর্ণনা করা এবং সর্বোপরি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ জীবনে সব প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা পোষণের ইঙ্গিত করে, যেন সে মানসিকভাবে খুবই শক্তিশালী। উল্লেখ্য, গত ৩রা অক্টোবর শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরে খাদিজাকে আচমকা চাপাতি দিয়ে আঘাত করে খুন করার চেষ্টা করে, যা ভিডিও আকারে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। খাদিজাকে গুরুতর অবস্থায় সিলেটের ওসমানী হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয় যেখানে প্রায় ২ মাস বেশ কয়েকটি অপারেশনের পর তাকে পুনর্বাসনের জন্য সাভারের সিআরপিতে পাঠানো হয়। সিআরপি’র মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিম খাদিজাকে পর্যবেক্ষণের পর ডাক্তার, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এবং কাউন্সেলরদের নিয়ে আট সদস্যের একটি বিশেষ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। এই বিশেষ টিম খাদিজাকে তিন মাসের চিকিৎসা পরিকল্পনায় সুস্থ করে তোলে।