হিজড়াদের নিষ্ঠুরতা

0
139
Print Friendly, PDF & Email

স্বপ্ন দেখতেন নামকরা ক্রিকেটার হওয়ার। ভাবতেন, এক সময় সারা দেশের মানুষ অলরাউন্ডার ক্রিকেটার হিসেবে তাকে এক নামে চিনবে। ছোটবেলা থেকেই লালন করা এই স্বপ্ন পূরণে তাই গ্রাম ছেড়ে রাজধানীতে এসেছিলেন সুজন। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার আবাহানী ইনডোর ক্রিকেট ক্লাবে। ভালোই করছিলেন সেখানে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ক্রিকেটার হওয়া হলো না। এখন তিনি ক্র্যাচে বগল চেপে খুঁড়িয়ে চলেন। গত ২০শে নভেম্বর রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকায় দুই হিজড়ার নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। এতে তার ডান পা ভেঙে যায়। চিকিৎসকরা বলেছেন, এক সময় স্বাভাবিক চলাচল করতে পারবেন। কিন্তু ক্রিকেট খেলতে পারবেন না কখনোই। সুজনের ভাষায়, শুধু পা-টায় ভাঙেনি, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তার স্বপ্ন। তিনি তার শখের ব্যাট-বল দিয়ে দিয়েছেন এলাকার ছেলেদের। তারা খেলে আর তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। এদিকে সুজনকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ইতিমধ্যে মোটা অঙ্কের ঋণের বোঝা চেপেছে তার পরিবারের ওপর। বাবার কৃষিকাজ আর ভাইয়ের চায়ের দোকানের ওপর দিয়ে কোনো রকম চলছিল তাদের সংসার। তার ওপর দিয়েই চলছিল তার ইনডোরে প্র্যাকটিস এবং পড়ালেখার খরচ। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অর্থাভাবে এখন সবকিছুই বন্ধ। সুজন মোল্লার বড় ভাই বলেন, ইতিমধ্যে তার ভাইয়ের পেছনে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। সংসারে কোনো পুঁজি ছিল না। সব টাকায় ধারদেনা এবং অল্পকিছু যে জমি-জায়গা আছে, তা বন্ধক রেখে টাকা যোগাড় করা হয়েছে। তিনি বলেন, তাও যদি ভাইটা আগের মতো খেলতে পারতো তবে দুঃখ থাকতো না।
সুজন মানিকগঞ্জ শিবালয় থানার মানিকনগর গ্রামের গফুর মোল্লার ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। ৭ বছর বয়সী ছোট ভাই লেখাপড়া করছে স্থানীয় একটি স্কুলে। কবি নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করা করা সুজন জানান, এ বছরই ওই কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল তার। বাবার কৃষিকাজ আর বড় ভাইয়ের চায়ের দোকানের আয় দিয়েই চলে তাদের সংসার। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বড় ক্রিকেটার হওয়ার। বড় ভাইয়েরও তাতে সায় ছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এসএসসি পাস করার পর চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন কবি নজরুল ইসলাম কলেজে। থাকতেন মেসে। পুরান ঢাকার আনন্দবাজার এলাকায়। এরপর পুরোদমে মনোনিবেশ করেন ক্রিকেটে। ভর্তি হন ধানমন্ডির ইনডোর ক্রিকেট ক্লাবে। সেখানে তিনি দুই বছর ধরে প্র্যাকটিস করে আসছিলেন। অলরাউন্ডার পারফরম্যান্সে তার প্রশিক্ষকরাও সন্তুষ্টি ছিলেন। খুব তাড়াতাড়ি ক্লাবে খেলার আশা করছিলেন তিনি। কিন্তু মাঝপথে থেমে গেল সেই স্বপ্ন। দুই হিজড়ার নির্যাতনে একটি পা এখন অচল। হাঁটাচলা করছেন ক্র্যাচের ওপর ভর করে।
সুজন জানান, গত ২৭শে নভেম্বর তিনি বাড়ি থেকে বাসে করে ঢাকা ফিরছিলেন। পথিমধ্যে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে বাস ট্রাফিক জ্যামে পড়লে দুই হিজড়া গাড়িতে ওঠে। তারা যাত্রীর কাছ থেকে চাঁদা তুলতে থাকে। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন। একজন হিজড়া তার গালে ও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয়। একপর্যায়ে সুজনের কোলের ওপর বসে পড়ে। এ সময় তিনি ওই হিজড়াকে ধাক্কা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তার শার্টের কলার চেপে ধরে। উভয়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এদিকে বাসে থাকা অপর হিজড়াও তাকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিতে থাকে। দুই হিজড়া মিলে তাকে টেনে-হেঁচড়ে বাস থেকে নামাতে গেলে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। চলন্ত বাস থেকে একজন পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ও অপরজন টেনে বাস থেকে নিচে ফেলে দেয়। এতে বাসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার পা ভেঙে যায়। এরপরও তাকে রাস্তায় ফেলে দুজনে উপর্যুপরি ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। একপর্যায়ে তার পায়ের ভাঙা হাড় বেরিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এ সময় তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন উদ্ধারে এগিয়ে আসে। পালিয়ে যাওয়ার সময় কবির ও সাজু নামে ওই দুই হিজড়াকে লোকজন আটক করে। পরে তেজগাঁও থানা পুলিশ তাদের আটক করে কোর্টে চালান করে দেয়। জানা গেছে, কোর্ট থেকে তারা জামিনে বেরিয়ে এসেছে। এদিকে সুজনকে উদ্ধারের পর এক ব্যক্তি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সুজনের স্বজনরা আসেন। ঢামেকের ১০১ নং ওয়ার্ডে তাকে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ একমাস চিকিৎসার পর ২৭শে ডিসেম্বর সুজনকে তার গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে আরো কয়েকবার ঢাকায় এনে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। সুজনের ভাই জানান, ইতিমধ্যে তার চিকিৎসা বাবদ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। সংসারে কোনো সঞ্চয় না থাকায় অল্প যে কিছু জমিজমা আছে, সেগুলো বন্ধক রেখে এবং ধারদেনা করে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ভাইটার খুব ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। এজন্য আর্থিক কষ্টের মধ্যেও ঢাকায় দিয়েছিলেন ক্রিকেট কোচিং করতে। ওই দুই হিজড়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কি না জানতে চাইলে সুজনের বড় ভাই জানান, চিকিৎসার পেছনেই অনেক টাকা যাচ্ছে। এখন মামলা করতে গেলে আরো টাকা খরচ হবে। সে টাকা কই পাবো? সুজন জানান, সারাক্ষণ ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকতাম। এখন পায়ের ভেতরে রড পরানো। হয়তো আর কখনো ক্রিকেট খেলতে পারবো না। তাই ব্যাট-বল এলাকার ছেলেদের দিয়ে দিয়েছি। ওরা খেলে আর আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। তিনি বলেন, তার মতো কেউ যেন এমন পরিস্থিতির শিকার না হয়। হিজড়ারা নিয়মিত বিভিন্ন বাস থেকে চাঁদা তোলে। না দিলে নাজেহাল করে। অনেকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। তার ওপর নির্যাতনকারী দুই হিজড়ার বিচারের পাশাপাশি চাঁদাবাজি বন্ধেরও দাবি জানান তিনি।

শেয়ার করুন