প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী এপ্রিলে দিল্লি সফরে যাচ্ছেন। গত ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে দু’দফা সফরের দিনক্ষণ প্রস্তাব এবং তা পিছিয়ে যাওয়ার পর এবার ‘ঝুলে থাকা’ সেই সফর চূড়ান্ত করতে গতকাল ঢাকায় আসেন ভারতের বিদেশ সচিব ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর। বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব এম নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধ্বে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। জয়শঙ্কর বলেন, এই সফরে প্রধানত পারস্পরিক স্বার্থ এবং ধাপে ধাপে উন্নয়ন উদ্যোগের পাশাপাশি যোগাযোগ সংযুক্তির বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। স্থল সীমান্ত এবং ছিটমহল সমস্যাসহ প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার পারস্পরিক সমাধানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য যদি ভালো হয়, আলোচনার মাধ্যমে আমরা যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবো। শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণের জন্য অন্যান্য খাতে সহযোগিতা জোরদার হওয়ায় এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ সংযুক্তি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বর্তমানে স্থবির সার্কের প্রসঙ্গ তুলে ধরায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এটি ডুবে যেতে দেবো না।’ বিবিআইএন মোটরভেহিকেল চুক্তির ব্যাপারে আলাপকালে শেখ হাসিনা চার দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই উদ্যোগ কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, বিবিআইএন উদ্যোগ কার্যকর হবে এবং আলোচনার মাধ্যমে এই উদ্যোগের সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধান করবো। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের প্রয়োজন অনুযায়ী তার দেশ বাংলাদেশে আরো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এবং বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর চূড়ান্ত করতে এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করতে দুইদিনের সফরে জয়শঙ্কর ঢাকায় রয়েছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে তিনি বেইজিং থেকে ঢাকায় পৌঁছান। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান। বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার দিল্লি সফর সংক্রান্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘বিশেষ বার্তা’ পৌঁছে দেন ড. জয়শঙ্কর। জাতীয় সংসদ ভবনে সেই সাক্ষাৎ-বৈঠক হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম সফরের পর শেখ হাসিনাকে দ্বিপক্ষীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই থেকে তার ফিরতি সফর নিয়ে কথাবার্তা চলছে। গত বছরের ডিসেম্বরে সরকার প্রধানের দিল্লি সফর প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত করা হয়। ওই মাসেই আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও চলতি মাসে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারত সফর করেন। সেখানে আকবর-শাহরিয়ার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে আকবর বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের জন্য দিল্লি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছে।’ অবশ্য গত অক্টোবরে ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় হয়। কিন্তু সেটি কোনো দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না। দ্বিপক্ষীয় সফরের বিষয়ে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রায়ই বলে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরটি ‘গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর’। দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর তা ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ সবাইকে জানানোই কাম্য বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ ওই কূটনীতিক কাম রাজনীতিক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আগেই বলেছিলেন, দিল্লির বিদেশ সচিব ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় এ নিয়ে মোদির বিশেষ বার্তা পৌঁছানোর পর শেখ হাসিনার তরফে গ্রিন সিগন্যাল পেলেই সফরের এজেন্ডা চূড়ান্ত করতে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সন্ধ্যায় রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানে সেই বৈঠকে বসেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা। সফররত ড. এস জয়শঙ্করের সম্মানে হোস্ট মো. শহীদুল হক সেখানে একটি নৈশভোজ আয়োজন করেছেন। ওই ভোজের মধ্য দিয়ে সেই বৈঠক বা আলোচনা শেষ হওয়ার কথা। ওই বৈঠকের বিষয়ে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখমাত্র বিকাশ স্বরূপ আগের দিন এক টুইট বার্তায় বলেন, জয়শঙ্কর এবং তার বাংলাদেশি কাউন্টার পার্ট শহীদুল হক দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সব বিষয়ই পর্যালোচনা করবেন। সেখানে হাই লেভেল ভিসিটিও (অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর) অন্তর্ভুক্ত থাকছে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেই ভোজ-বৈঠকটি চলছিল। উল্লেখ্য, আজ সকালে তার দিল্লি ফেরার কথা রয়েছে।
দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকবেন হাসিনা: প্রধানমন্ত্রীর দিল্লির সফরের প্রস্তুতি অনেকটাই এগিয়ে গেছে আভাস দিয়েছেন ঢাকার কূটনীতিকরা। তারা বলছেন, আসন্ন সফরে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির অতিথি হিসেবে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি ভবনেই থাকবেন। অতীতেও প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফর করেছেন, এমনকি প্রণব মুখার্জির আমলেও তার সফর হয়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম তাকে এমন সম্মান জানানো হচ্ছে। ঢাকা ও দিল্লি কূটনৈতিক সূত্রে এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে যে নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয় তিস্তা চুক্তির জট খুলছে না। কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর লড়াইয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তিস্তাচুক্তি। এর পাশাপাশি সমপ্রতি গঙ্গা ব্যারেজ নিয়ে আলোচনা থেকে সরে আসার কথা বলছেন মমতা ব্যানার্জী। কারণ ব্যারেজটি হলে রাজ্যের কিছু এলাকা ভাঙনের কবলে পড়বে, এই আশঙ্কায় তিনি গঙ্গা ব্যারেজের বিরোধিতা করছেন। এ নিয়ে দুই দেশের একটি কারিগরি কমিটি থেকে রাজ্যের প্রতিনিধিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন মমতা। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, স্থলসীমান্ত চুক্তির মতো সব পক্ষকে নিয়ে তিস্তা চুক্তি সইয়ের কথা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৫ সালের জুনে ঢাকায় এসে এ জন্য আরো সময় চেয়েছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবে অগ্রাধিকার প্রসঙ্গ ও দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয় হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশ যৌক্তিকভাবেই তুলবে। তাছাড়া ভারতকে নিয়েই যেহেতু বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারেজ তৈরির কাজ শুরু করতে চায়, এ জন্য যৌথ কারিগরি কমিটি করা হয়েছে। বাংলাদেশ আশা করছে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে বিষয়টি নিয়ে ভারতের তরফে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসবে। আসন্ন সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার সহযোগিতাকে নতুন স্তরে নিতে রূপরেখা চুক্তি করতে আগ্রহী ভারত। এ নিয়ে এক সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতিও চলছে বলে সেগুনবাগিচার সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, আসন্ন সফরে দিল্লির অগ্রাধিকারে থাকছে ‘নিরাপত্তার বিষয়টি। এরই মধ্যে এ ইস্যুতে ভারতের অনেক উদ্বেগ দূর করেছে বাংলাদেশ। দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন বিশেষত দেশটি থেকে সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার বিষয়ে দিল্লির থিংকট্যাঙ্কদের উদ্বেগ রয়েছে। চীনের মতো ভারতও বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়। এজন্য তারা বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ নিয়ে আলোচনায় গত বছর ঢাকা সফর করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। সেই সফরের পর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রিতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার লাইন অফ ক্রেডিট বাংলাদেশকে দেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিরক্ষা বিষয়ে প্রায় ১০টির মতো চুক্তি আছে। কিন্তু তার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশের বাংলাদেশের ‘সামরিক চুক্তি’র আগ্রহ রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং বিশ্ব বাস্তবতা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন বলে আশা করে সেগুনবাগিচা।