বাংলা ভাষা ব্যবহারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জীবন-জীবিকার জন্য অনেক সময় অন্য ভাষা শিখতে হয় এবং অনেক সময় জ্ঞান পিপাসার জন্যও ভাষা শিখতে হয়। কিন্তু তার জন্য নিজ ভাষা ভুললে চলবে না। নিজের আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষায় কথা বলা স্বকীয়তার পরিচায়ক। কিন্তু বাংলা ভাষাকে কোনোভাবেই বিকৃত করা যাবে না। বাংলা ও ইংরেজির মিশেলে ‘বাংরেজি’ থেকে ছেলে-মেয়েদের সরিয়ে আনতে হবে। গতকাল শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত পাঁচদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ইদানীং বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি বলার একটা বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক ছেলে-মেয়ের মাঝে এখন এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে না- এমন একটা ভাব। তিনি বলেন, এই জায়গা থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের বেরিয়ে আসতে হবে। যখন যেটা বলবে সঠিকভাবেই উচ্চারণ করবে এবং বলবে।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ভাষার ওপর বারবার আঘাত এসেছে। এটাকে কখনো আরবি হরফে এবং কখনো রোমান হরফে লেখার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বাঙালি কখনো তা মেনে নেয়নি। এটা হচ্ছে বাঙালিদের চরিত্র, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। এ জন্যই আমরা সবসময় বলি একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করার। সেভাবে আমরা স্বাধীনতাও অর্জন করেছি এই সংগ্রামের পথ বেয়ে। অন্য ভাষার প্রতি তাঁর কোনো বৈরিতা নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে নিজের ভাষা আগে শিখতে হবে। সেই সঙ্গে অন্য ভাষাও আমরা শিখবো। ভাষা শিক্ষার মধ্যে আলাদা একটা মাধুর্য আছে। পৃথিবীতে একমাত্র মানব জাতিরই ভাষা আছে। তারাই কেবল বলতে পারে। তিনি বলেন ‘আমাদের ভাইয়েরা রক্ত ও জীবন দিয়ে আমাদের এই ভাষা উপহার দিয়ে গেছেন, এর মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে’।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। ইউনেস্কোর ভাষা বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যানভিটা অ্যাবি অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ঢাকায় ইউনেস্কো প্রতিনিধি বিট্রেস কালডুন, শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসাইন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জিনাত ইমতিয়াজ আলী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
আমাদের ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা সাতই মার্চের ভাষণে গোপালগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। তিনি এ ভাষা সব সময় ব্যবহার করতেন। বঙ্গবন্ধুর আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে তার শিক্ষকদের আলোচনার স্মৃতিচারণা করে বঙ্গবন্ধু-তনয়া বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়তাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক মাঝে মাঝে বলতেন, “উনি (বঙ্গবন্ধু) এভাবে বলছেন কেন?” তখন আমি বলতাম, “স্যার উনি (বঙ্গবন্ধু) যখন কথা বলেন জনগণের জন্যই বলেন। জনগণ সহজে উপলব্ধি করবে এবং জনগণের হৃদয়ে পতিত হবে সেটাই বলতেন। এটাকে সংশোধন করা যায় না। এটা স্বতঃস্ফূর্ত।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণার জন্য তাঁর সরকারের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার তথ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা জানেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বিশ্বের দরবারে এ ভাষার গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করে আমি নিজেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিয়মিত বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বাংলা ভাষাভাষীর স্থান হচ্ছে ৬ষ্ঠ। সেজন্য জাতিসংঘ যাতে বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে তার জন্য জোর প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে।
মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সালে ৪ঠা জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় সকল গণ-আন্দোলনের পতাকাবাহী সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ, তমুদ্দীন মজলিস এবং আরো কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করে ধর্মঘট ডাকা হয় এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ জনগণকে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সমগ্র দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করে। ধর্মঘট চলাকালে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাধারণ ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৫ই মার্চ বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও সংগ্রামের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস সারাবিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস সারাবিশ্বের মানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার। মায়ের ভাষায় কথা বলতে এবং ভাষার অধিকার আদায়ে এত মানুষ শহীদ হয়েছেন, জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সেই ইতিহাসও সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার।