২০১৩ ও ২০১৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রহীতাদের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল (কিস্তি পরিশোধের নতুন সূচি) নীতিমালা শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুযোগে অনেক পুরনো খেলাপিরাও রাজনৈতিক অজুহাতের সুযোগ নেন। এতে করে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। কিন্তু বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করার এক বছর পার হতেই পুনরায় খেলাপি হয়ে পড়ছেন গ্রহীতারা। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমানোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশল ভেস্তে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, অসাধু গ্রহীতাদের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তারা যোগসাজশ করায় পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে উঠেছে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকও অনেক অন্যায় আবদার রক্ষা করেছে। এতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা তাদের সুবিধামতো নীতি প্রণয়নে হস্তক্ষেপ করেছে। এতে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়েছে। দেড় বছর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ যারা নিয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগই পুরনো ঋণ খেলাপি। তাদের সমস্যাও রাজনৈতিক নয়। সময়ের ব্যবধানে তারা আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। এতে জাতি হিসেবে আমরা খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে শিথিল নীতিমালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ৫০ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এর মধ্যে মার্চ-১৬ পর্যন্ত সময়ই পুনরায় খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১১ হাজার ২৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে পুনঃতফসিলকৃত মোট ঋণের ২৭ শতাংশ আবার খেলাপি হয়ে গেছে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো হালনাগাদ প্রতিবেদন তৈরি করেনি।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের মধ্যে অর্ধেক পরিমাণই আবার খেলাপি হয়ে গেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ পুনরায় খেলাপি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণ আদায়ের পরিমাণও বেড়েছে। এ সময় ব্যাংকগুলো ১৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকার ঋণ আদায় করেছে। এতে পুনঃতফসিল করার পর আদায়ের হার দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ। এ ছাড়া এখনও ৩০ হাজার ৫৬২ কোটি টাকার ঋণ অশ্রেণিকৃত রয়েছে। বর্তমানে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা যায়, শিথিল নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় খাতের ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে তিন হাজার নয়শ’ কোটি টাকা। অর্থাত্ পুনঃতফসিলকৃত ঋণের প্রায় ৩৮ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। যা পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ৬৪ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সকালের খবরকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে যেখানে গণহারে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে মানদণ্ড সঠিক ছিল না। এতে পুনরায় সেসব ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। এতে করে যে সমস্যাটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমাধান করতে চেয়েছেন, সেটা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিলির সুযোগের মাধ্যমে এমন একটা বার্তা দেওয়া উচিত ছিল, যাতে পরবর্তীতে এমন সুযোগ তারা আর না পায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবারই তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। ঘুরে-ফিরে ওই খেলাপি গ্রহীতারাই আবার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। এতে অনেক সক্ষম গ্রহীতাও ঋণের টাকা ফেরত দিতে চায় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে গেছে। কোনো নীতি প্রণয়নের পরে তার ওপর অটল থাকাটা জরুরি। তা নাহলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত সকালের খবরকে বলেন, অর্থনীতিতে বিভিন্ন সমস্যা থাকায় অনেক গ্রাহকের নগদ অর্থের প্রবাহ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে সুবিধা কাজে লাগেনি। এর বহু কারণ থাকতে পারে, উপকারভোগীর মধ্যে যারা ক্ষমতাশালী তারা কিছু অর্থ জমা করে নিয়মিত গ্রাহক হয়ে আরও ঋণ সুবিধা নিয়েছেন। যেহেতু তারা অভ্যাসগত বা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি, তাই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেননি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় খাতের দুই বিশেষায়িত ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় ১ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল। এর মধ্যে আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩০৪ কোটি টাকা। এ সময় বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো ১৩৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা, খেলাপি হয়ে গেছে ৩৮ কোটি টাকা এবং অশ্রেণিকৃত রয়েছে ১৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, নির্ধারিত সময় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ৩৮ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। আর আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা, যা পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ৩৯ শতাংশ। এ ছাড়া ২৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকার ঋণ অশ্রেণিকৃত রয়েছে।