দেশ-বিদেশে পরিবেশবাদী ও বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার পরও এগিয়ে চলেছে বহুল আলোচিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণযজ্ঞ। ইতোমধ্যে প্রাথমিক বিভিন্ন কাজ শেষ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসে শুরু হবে মূল বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণের কাজ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে ইউনেস্কো। সেই সুন্দরবনের কাছে রামপালে এই বিদ্যুত্ প্রকল্পটি বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ উদ্যোগে করা হচ্ছে। এটির উত্পাদন ক্ষমতা হবে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশ লাখ টন কয়লা এটিতে ব্যবহার করা হবে। এই বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে পরিবেশবাদীরা এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। তারা বলছেন, বিদ্যুেকন্দ্র নির্মিত হলে, বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে আশপাশের এলাকা। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার এবং ইন্টারন্যাশনাল কনজার্ভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বলেছে, এমন সম্ভাবনা খুব প্রবল যে, এই বিদ্যুেকন্দ্রের দূষণ সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। ইউনেস্কো বলেছে, এই বিদ্যুেকন্দ্রটি এমন কোনো জায়গায় সরিয়ে নেওয়া উচিত, যাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি না হয়।
তবে এসব শঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়ে সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, উন্নত প্রযুক্তির এই বিদ্যুেকন্দ্রের কারণে পরিবেশ দূষণ হবে না। ক্ষতি হবে না সুন্দরবনেরও। বরং বহু মানষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ওই এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে।
বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) সূত্র জানায়, এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকায় ৯১৫ একর জমিতে মাটি ভরাট কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে সীমানা প্রাচীর, আবাসিক ভবন, অফিস, পাঁচটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, অফিসসহ বেশ কয়েকটি অবকাঠামো। মূল বিদ্যুেকন্দ্রের পশ্চিম পাশে পশুর নদীতে স্থাপন করা হয়েছে দুটি পন্টুন ও জেটি স্থাপন।
বিআইএফপিসিএলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল রাতে সকালের খবরকে বলেন, গত সপ্তাহে এবং তার আগের সপ্তাহে দু’দফায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এখন ভেটিংয়ের কাজ চলছে। এই প্রক্রিয়ায় শেষে অর্থনৈতিক চুক্তি হবে। এরপরই শুরু হবে বিদ্যুেকন্দ্রের মূল নির্মাণ কাজ। আগামী মাসেই এই নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রটি নির্মাণ করবে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল)। গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিলি) সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির চুক্তি হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, চূড়ান্ত চুক্তি করার তিন মাসের মধ্যে অর্থনৈতিক চুক্তি করতে হবে। অথনৈতিক চুক্তির ৪১ মাসের মধ্যে প্রথম ইউনিট এবং ৪৬ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট উত্পাদনে আনতে হবে। এই হিসেবে কেন্দ্র স্থাপন শেষ হবে ২০১৯ সালের শেষে।
রামপাল কেন্দ্রের ৭০ শতাংশ অর্থ ঋণ নেওয়া হবে। এই ঋণ দেবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। বাকি ৩০ শতাংশ পিডিবি ও এনটিপিসি যৌথভাবে বিনিয়োগ করবে।
রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র নিয়ে গেল বছরের অক্টোবরে ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ৩০ পৃষ্ঠার বেশি দীর্ঘ এই প্রতিবেদনে রামপাল বিদ্যুেকন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মূলত চার ধরনের ক্ষতির আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়।
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার এবং ইন্টারন্যাশনাল কনজার্ভেশন ইউনিয়নের (আইইউসিএন) তিনজন বিশেষজ্ঞ সরেজমিনে ঘুরে দেখে এবং বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে কয়লা পুড়িয়ে। এই কয়লা পোড়ানোর পর সেখান থেকে থেকে নির্গত কয়লার ছাইকে সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ইউনেস্কোর ওই প্রতিবেদনে।
বিদ্যুেকন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য এবং পানিকে দ্বিতীয় হুমকি হিসেবে গণ্য করছে ইউনেস্কো। এই প্রকল্পকে ঘিরে সুন্দরবন এলাকায় যেভাবে জাহাজ চলাচল বাড়বে এবং ড্রেজিং করার দরকার হবে, সেটিও সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
আর সবশেষে বিদ্যুেকন্দ্রকে ঘিরে ওই অঞ্চলের সার্বিক শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও সুন্দরবনের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে মনে করে ইউনেস্কো।
রামপাল বিদ্যুেকন্দ্রের এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের (ইআইএ) জন্য আইউসিএন যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা ঠিকমতো মেনে চলা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় এই প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতি এড়াতে এই বিদ্যুেকন্দ্রে যে ধরনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং যে রকম আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা উচিত, সেটাও করা হচ্ছে না।
ইউনেস্কো সুন্দরবনের কাছে এই বিশাল কয়লা বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ইউনেস্কো হুশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এ রকম একটি প্রকল্প বাংলাদেশে সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করবে।
গত ২১ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, রামপাল বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণ বন্ধ করবে না সরকার। আন্তর্জাতিক সংগঠন ও পরিবেশবাদীদের বক্তব্য আমরা শুনছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। একই সঙ্গে আমরা প্রকল্পের কাজও চালিয়ে যাব।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বর্তমান বিশ্বে ক্লিন কোল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মাতারবাড়ী, পায়রা ও রামপালে কয়লা-বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিবেশবাদীদের ধারণা পাল্টে যাবে।
গত মাসে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নোবেলজয়ী পরিবেশবাদী আল গোর।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা নিয়ে কাজ করছেন আল গোর। তার উদ্বেগের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেন এবং বাংলাদেশে এসে সরেজমিন প্রকল্পটি দেখার আহ্বান জানান।