গণতন্ত্রে টেকসই হয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

0
217
Print Friendly, PDF & Email

উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের ঘাটতি মেনে নেওয়া উচিত কি না—এই প্রশ্নের একটি জবাব এসেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) দ্বিতীয় বার্ষিক অর্থনৈতিক সম্মেলনে।
এতে বিশ্বব্যাপী চলতে থাকা নানা তাত্ত্বিক আলোচনা তুলে ধরে একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছেন, উন্নতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে ভালো শাসনব্যবস্থা। স্বৈরতন্ত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় স্বল্পমেয়াদি ও টালমাটাল। অন্যদিকে গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয়। এ ব্যবস্থায় মানবসম্পদের উন্নতি বেশি হয়। বিনিয়োগকারীদেরও আস্থা বেশি থাকে।
সানেমের দুই দিনের এ সম্মেলন চলছে রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে। এবার সম্মেলনের বিষয়বস্তু ‘সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রবৃদ্ধির ব্যবস্থাপনা’। গতকাল শনিবার সম্মেলনের প্রথম দিনের অধিবেশনগুলোতে প্রবৃদ্ধি ও রাজনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, দারিদ্র্য ও বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় নীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, খাতভিত্তিক অর্থনীতি, শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
উদ্বোধনী অধিবেশনে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেন যুক্তরাজ্যের উলস্টার ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী। উন্নয়নের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র যে স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে ভালো শাসনব্যবস্থা, তা বিভিন্ন যুক্তি ও তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে তিনিই তুলে ধরেন। ওই অধ্যাপক বলেন, উন্নতির পথে থাকা দেশগুলোতে যখন গণতান্ত্রিক অধিকার খানিকটা কেড়ে নেওয়া হয়, তখন দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো, কাজটি ঠিক হয়নি। অন্য পক্ষ বলে, গণতান্ত্রিক অধিকার কিছুটা ক্ষুণ্ন হলেও এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতি পেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এ প্রশ্নটির পরিবর্তন হওয়া দরকার। প্রশ্নটি এমন হওয়া উচিত, গণতন্ত্র কি উন্নতির পথে বাধা তৈরি করছে?’
উন্নতি কেবল আর্থিক দিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলে উল্লেখ করে সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী আরও বলেন, উন্নয়ন বলতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারও বোঝায়। এদিক দিয়ে গণতন্ত্র উন্নয়নের একটি অংশ। শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিতর্ক তুলে ধরে ওই অধ্যাপক আরও বলেন, তত্ত্বের জায়গায় এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বৈরাচার গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো। একইভাবে গণতন্ত্র উন্নয়নের পথে বাধাও তৈরি করে না।
সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেন, স্বৈরাচার যখন দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তখন উন্নয়ন এগিয়ে নেয়। বাংলাদেশে এটা ঘটেছে, সে নামগুলো সবার জানা। তবে স্বৈরাচারের প্রবৃদ্ধি স্বল্পমেয়াদি হয় ও অনিশ্চয়তা থাকে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে এসে সব তাত্ত্বিক আলোচনা বিবেচনায় নিয়ে এ উপসংহারে আসা যায় যে, উন্নয়ন এগিয়ে নিতে গণতন্ত্র স্বৈরশাসনের চেয়ে ভালো। এটা প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে, মানবসম্পদের উন্নতি করে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা দেয়। উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের ঘাটতি মেনে নিতে হবে—এ বিতর্কের কোনো সুযোগই নেই।
গরিব দেশে গণতন্ত্র হয় না—এ বিতর্কও নাকচ করে দিয়ে সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেন, ‘কাউকে বলতে দেবেন না আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নই। বরং গণতন্ত্রের ঘাটতি মেটাতে আমাদের লড়াই করতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করুন, তা আসছে—এটা বলতে দেওয়া যাবে না।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি’ শীর্ষক একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ডেভিড হিউম। দীর্ঘ আলোচনা শেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো সহায়তার আশায় বসে নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমেরিকা, ইউরোপসহ ধনী দেশগুলোর কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, এর জন্য ব্যয় করতে হবে কি বাংলাদেশের গরিব মানুষকে?
সম্মেলনের এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সানেমের চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকার। এতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বক্তব্য দেন।
সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ। তিনি বলেন, বাজার অর্থনীতি দিয়ে দেশের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন আনতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা সেখানে একটি সম্পূরক কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে একটি অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বারকাত-ই-খুদা বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে শিক্ষা ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনার ঘাটতি আছে। বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ আরও বাড়ানো উচিত।
ব্র্যাক রিসার্চ অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিভিশনের পরিচালক আবদুল বায়েস বলেন, বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ তরুণ এখন শিক্ষায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই, তারা প্রশিক্ষণেও নেই। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষায় বেকারত্ব বেশি। তাদের বাজারব্যবস্থায় নিয়ে আসতে হবে।
সানেমের সম্মেলনটি আজ রোববার শেষ হবে।

শেয়ার করুন