জাতিগঠনে যোগ্য নাগরিক গড়ে তুলতে শিক্ষা অপরিহার্য হলেও সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে শিক্ষার মানদ নির্ণয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা বলছেন, শিক্ষ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রদান ও প্রশ্ন তৈরির জন্য যোগ্য, সৎ ও মেধাবীদের না বসিয়ে দলীয়করণের জন্যই একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। কোনোভাবেই সরকার এ কলঙ্ক থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রীর দীর্ঘ আট বছরে প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। শিক্ষাবিদরা সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ, কর্মোপযোগী সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে আল্লাহর ওয়াস্তে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, দলীয়করণ বন্ধ করে মেধা ও যোগ্যতম ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। বিগত বিএনপির সরকারের সময়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে পরীক্ষায় নকল বন্ধ করা হলেও গত ৮ বছরে সব পরীা এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন সমার্থক হয়ে গেছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা-আলাপ-বিলাপ-উদ্যোগ-আয়োজন অনেক কিছু হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেই চলেছে। পাবলিক পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা, পদোন্নতির পরীক্ষাসহ এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নেই। সরকার এেেত্র কানে ‘তুলা’ দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। তবে সমালোচনার মাত্রা যখন বেড়ে যায়, তখন শিামন্ত্রী মুখ খোলেন। প্রথমেই ঘটনাটিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার জন্য বলেন। পরিস্থিতি বাইরে চলে গেলে এরপর একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সর্বশেষ বলেন, ‘সাী-প্রমাণ পেলে’ তিনি ব্যবস্থা নেবেন। এবারের সর্বশেষ এসএসসি পরীায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। অনেকেই তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াকে জাতির ‘শিায় গলায় ফাঁস’ হিসেবেও চিহ্নিত করছেন। শিা েেত্র বর্তমানে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। ইতিহাস বিকৃতি আর ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজটি দতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছে। শিা নিয়ে এমন হেলাফেলা আর ছেলেখেলা দেখে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই গভীর শঙ্কা প্রকাশ করছেন। দেশকে, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ডুবিয়ে অন্ধ বানানোর একটা প্রক্রিয়া চলছে বলে ুব্ধ মানুষজন বলাবলি করছেন। এসব ঘটনায় অনেকে আবার ‘ক্রান্তিকাল’ ও ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ দেখছেন। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, যেকোনো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া অমার্জনীয় অপরাধ। দায়িত্বশীলরাই এই অপরাধের জন্য দায়ী। তাদের ব্যর্থতার জন্য জাতির সর্বনাশ হচ্ছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ টেনে বলেন, এখানে কোনো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিক সেটার খোঁজ নিয়ে প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই পরীক্ষা বাতিল করে নতুন পরীক্ষা নেয়া হয়। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তা ঠেকাতে পেরেছে। কিন্তু জাতীয়ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্য ও যথার্থদের উপযুক্ত পদে না বসিয়ে দলীয়, দুর্নীতিবাজদের নিয়োগের ফলেই একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। ছাত্রদের ভাল মানের পড়ার জন্য শিক্ষার উপয্ক্তু পরিবেশ, যোগ্য, বিশ্বস্ত ও বিবেকসম্পন্ন লোকদের শিক্ষার ব্যবস্থাপনা, পরীক্ষা নেয়া এবং প্রশ্ন তৈরি-বিতরণের কাজে দায়িত্ব দিলে এসব অভিযোগ আসত না। শিক্ষায় সৃজনশীলতা না থাকায় এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয়করণ দায়ী। তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সুশিক্ষার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয়করণ পরিহার করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। : বিগত বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক এমপি শামছুল আলম প্রামাণিকের এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মনে পড়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিক্ষাঙ্গনের ব্যাপক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কথা। তখন পরীক্ষায় নকল এমন হারে বেড়েছিল যে, পরীক্ষা কেন্দ্রে নকলের হাট বসত। এখন পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এ যে এক ডিজিটাল নকলবাজি। তিনি বলেন, বিএনপির শাসনামলে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য বন্ধ হলেও বর্তমানে সঠিক তদারকির অভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়াবহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। : শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে সাবেক ভিসি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে বলেন, একের পর এক প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে দেশবাসী ও অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকারের ভূমিকা রহস্যজনক। তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য শিক্ষামন্ত্রী পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। এটি নৈতিকভাবে সরকারের জন্যও অপমানজনক। বর্তমান সরকারের সময়ে সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস জাতির সর্বনাশ করে ফেলেছে। শিক্ষার মানদন্ড যাচাই সঠিকভাবে হচ্ছে না। যেদেশের সরকার ব্যবস্থাপনাই ভুয়া, খোদ প্রধানমন্ত্রীই অনৈতিকতা উৎসাহিত করেন সেখানে মেধার সঠিক যাচাইয়ের মানদন্ড নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। : শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভুইয়া গতকাল দিনকালকে বলেন, এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিসিএস পর্যন্ত সকল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো পরীক্ষা নেই যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট বের হলেও শিক্ষামন্ত্রী মিথ্যাচার করছেন। অন্যদিকে পরীক্ষার মূল্যায়নও যথাযথ হচ্ছে না। পরীক্ষা দিলেই পাস। ফলে মেধার মূল্যায়ন কমে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার না থাকায় এখন কোনো জবাবদিহিতা নেই|