জঙ্গি হামলার বিভীষিকায় রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে পাকিস্তানের লাল শাহবাজ কলন্দর মাজারে। সেহওয়ান শহরের প্রাণচঞ্চল এ স্থানটিতে এখন হৃদয়বিদারক নীরবতা। স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি আকাশে-বাতাসে। শোকের ছায়া নেমে এসেছে পাকিস্তানজুড়ে।
ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮৮ জনে দাঁড়িয়েছে। হামলায় আহত হয়েছে কয়েক শ’ মানুষ। নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন শিশু রয়েছে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সেনাবাহিনীর পাল্টা অভিযানে কমপক্ষে ৪৪ জন ‘সন্ত্রাসী’ নিহত হয়েছে। এ হামলার জন্য আফগানিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গিদের দায়ী করেছে পাকিস্তান। হামলার পর দেশটি প্রতিবেশী আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দিয়েছে। কাবুলকে ৭৬ জন ‘সন্ত্রাসী’র তালিকা দিয়ে পাকিস্তান তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ বা ইসলামাবাদের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছে। এ খবর দিয়েছে আল জাজিরা, বার্তা সংস্থা এএফপি ও এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।
খবরে বলা হয়, পাকিস্তানে ওই মাজার হামলা ২০১৪ সালের পর দেশটিতে হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সেহওয়ানে বৃহস্পতিবার একটি মাজারে জড়ো হওয়া অনুসারীদের টার্গেট করে আত্মঘাতী হামলাটি চালানো হয়। আত্মঘাতী হামলাটির দায় নিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তাদের অনুমান হামলাকারীদের মধ্যে অন্তত একজন নারী হয়ে থাকতে পারে। ১৩৫৬ সালে নির্মিত ওই মাজারটি ছিল সৈয়দ মুহাম্মদ উসমান মারওয়াদি। এই সুফি দার্শনিক ও কবি লাল শাহবাজ কালান্দার নামে বেশি পরিচিত। তাকে পাকিস্তানে ব্যাপক সম্মানের চোখে দেখা হয়।
আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ, ৭৬ ‘সন্ত্রাসী’ হস্তান্তরের দাবি
হামলার পরপর আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। এছাড়া ৭৬ ‘সন্ত্রাসী’কে অবিলম্বে হস্তান্তর করার দাবি জানাতে ইসলামাবাদে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পাক সেনাবাহিনী। আফগান রাষ্ট্রদূতের কাছে ‘আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে হামলা চালানো’র প্রতিবাদ জানানো হয়। শুক্রবার পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বলেছে, আফগানিস্তানকে অবশ্যই ৭৬ জন লোকের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হানিফ আতমারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হামলার দায় স্বীকার করেছে। এ সংগঠন আফগানিস্তানের ভেতরে থেকে অপরাধকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি সেনাপ্রধানের
এদিকে হামলার পরপরই সামরিক বাহিনী বেশ কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে। সেনাপ্রধান এ হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আসিফ গফুরের এক টুইট বার্তায় সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃত করা হয়। আসিফ গফুর বলেন, সেনাপ্রধান আসিফ বাজওয়া বলেছেন, এ জাতির প্রত্যেক ফোঁটা রক্তের প্রতিশোধ নেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ নেয়া হবে। কারও জন্য আর কোনো ধৈর্য দেখানো হবে না। তবে সেনাপ্রধান সকলকে শান্ত থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন। বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, হামলার পরপর রাতভর চালানো নিরাপত্তা অভিযানে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৪৪ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি। এছাড়া আটক হয়েছে আরো অনেক সন্দেহভাজন।
নিন্দার ঝড়
ভয়াবহ এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি, পাকিস্তানের বিরোধী দল পিপিপির প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো, সিন্ধু গভর্নর মোহাম্মদ জুবাইর ও মুখ্যমন্ত্রী সৈয়দ মুরাদ আলি শাহ, রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ইমরান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলিসহ অনেকে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের জন্মের আগেও সুফী মানুষজন এখানে ছিলেন। তারা পাকিস্তান গঠনের লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের ওপর হামলা জিন্নাহর পাকিস্তানের ওপর সরাসরি হুমকি। তাই সেভাবেই এটি মোকাবিলা করা হবে।’ আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বলেন, ‘সুফীবাদ সবসময়ই মানুষের মাঝে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রচার করে। তাই তাদের ওপর হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা প্রমাণ করেছে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই।’ তিনি বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, আইএস সহ সব জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী লড়ে যাচ্ছে। হামলার পর পাক প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় অর্থমন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সোমবার থেকে সিরিজ হামলায় নিহত শতাধিক
বৃহস্পতিবারের ওই হামলাটি ছিল পাকিস্তানের সামপ্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত হামলাগুলোর একটি। বৃহস্পতিবার মাজার হামলায় নিহত ৮৮ জন সহ সোমবার থেকে দেশটিতে বিভিন্ন হামলায় কমপক্ষে ১১২ জন নিহত হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগ হামলার দায় নিয়েছে পাকিস্তানি তালিবান ও এর বিভিন্ন অংশ। সোমবার পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাহোরের এক সমাবেশে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৩ জন নিহত হয়েছে। বুধবার একটি সরকারি কার্যালয়ে আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। পেশওয়ারে সরকারি কর্মচারীদের ওপর আরেক আত্মঘাতী হামলায় ৬ জন নিহত হয়। মঙ্গলবার বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েট্টায় বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।
রক্তস্নাত মাজারে এখন ভয়াল নীরবতা: এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াল জঙ্গি হামলার পর মাজারের ভেতরের মর্মবিদারক আবহের বর্ণনা। এতে বলা হয়, মাজারে প্রবেশ করলে প্রথমেই নাকে এসে লাগবে রক্তের গন্ধ। ধূসর-সাদা মার্বেল ফ্লোরের জায়গায় এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাথরের টুকরো। পুরো স্থানজুড়ে রক্তের লম্বা দাগ। নিচ থেকে দৃষ্টি সরালেই চোখে পড়বে দেয়ালের এখানে সেখানে আটকে থাকা মানব শরীরের ছিন্নভিন্ন মাংস। এক মুহূর্তের বিভীষিকায় প্রাণচঞ্চল স্থানটি এখন পরিণত হয়েছে কসাইখানায়। কয়েক ঘণ্টা আগে ভিন্ন আরেক বিভীষিকার অবতারণা হয়েছিল এখানে। হামলা পরবর্তী মুহূর্তগুলোকে কেউ তুলনা করেছেন কারবালার যুদ্ধের সঙ্গে। লাশের ওপর দিয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছিল আহত আর হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা। অন্যরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ব্যক্তিদের উঠাতে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্তৃপক্ষের ওপর। বলেছেন, এমন কিছু হওয়ারই কথা ছিল। কেননা, কর্তৃপক্ষ মানুষের উদ্বেগে কান দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি কখনো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে দৃষ্টিভঙ্গিই আপনি বিশ্বাস করেন না কেন, আগের রাতে যা ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে এক রক্তবন্যা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া: মাজার প্রাঙ্গণের কাছে দোকানদারি করেন গুলাম হায়দার সোলাঙ্গি (৪০)। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণ ঘটে আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টার দিকে। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম জেনারেটর বিকল হওয়ার কারণে শব্দ হয়েছে। কিন্তু পরে যখন দেখলাম মানুষজন এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে আর কারো আপাদমস্তক রক্তে রঞ্জিত; তখন আমরা দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওই দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেখানে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। কোনো পুলিশ না, কোনো উদ্ধারকর্মীও না। সবকিছু আমরা নিজেরাই করেছি। অটোরিকশা ডেকে নিহত আর আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।’ মাজারের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সিকান্দার আলির (৫৬) ভাষ্যে শোনা গেছে ভয়াবহ পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা। অন্তঃসত্ত্বা মৃত এক নারীর গর্ভ থেকে সন্তান প্রসব হতে দেখেন তিনি। এ দৃশ্য দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সিকান্দার আলি।
তিনি বলছিলেন, ‘কেয়ামত কেমন হবে তার একঝলক প্রত্যক্ষ করেছি আমি।’ একথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সিকান্দার। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বলেন, ‘এই নৃশংসতা ছিল অসহনীয়। বোমা হামলাকারী, আর তাকে যারা পাঠিয়েছে তাদের নিষ্ঠুরতার সীমা নেই। কে এমন কাজ করতে পারে?’
মাজারের নিকটবর্তী বাসিন্দাদের বেশিরভাগই সেখানকার নিরাপত্তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, লাল শাহবাজ কলন্দর মাজারটি দেশের অন্যতম শ্রদ্ধার একটি মাজার। তারপরও সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবসময় ছিল অপর্যাপ্ত।
স্বেচ্ছাসেবী চৌকিদার মুহাম্মদ রাফি (২৫) বলেন, ‘আপনি দেখবেন কেতাদুরস্ত পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ডজনখানেক পুলিশ। কিন্তু এখানে হাতেগোনা কয়েকজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আর নিজেদের দায়িত্বটাও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেনি তারা।’