দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর থানার বীরেশ্বরপুর কলেজ। এখানে আগেই ৩৯টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে শাসকদলের ছাত্র সংগঠন। কয়েকদিন আগে সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদ গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। আর তা নিয়েই বিবাদে জড়িয়ে পড়ে শাসকদলের দুটি গোষ্ঠী। মন্দিরবাজারের তৃণমূল বিধায়ক জয়দেব হালদারের নেতৃত্বে লোকজন কলেজের ভিতর ঢুকে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। কারণটা কী? ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য, কেন বিধায়ক গোষ্ঠীর কাউকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়নি, সেই রাগেই নাকি এই হামলা। ওই সময় বাধা দিতে গেলে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়ায় মাথায় আঘাত লাগে কলেজ অধ্যক্ষের।
এ তো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। ভাঙড় কলেজে আরাবুল ইসলামের জগ ছুঁড়ে মারার ঘটনাও মন থেকে মুছে যায়নি। মানুষ ভুলে যায়নি রায়গঞ্জ কলেজের গন্ডগোল বা গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে দুপক্ষের সংঘর্ষের মাঝে গুলিতে প্রাণ হারানো সাব ইনসপেক্টর তাপস চৌধুরির কথাও।
এবার আসা যাক আরও একটি খবরে। গত ৭ জানুয়ারি নেতাজি ইনডোরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে সভা ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি কী বলেছিলেন? সাম্প্রতিক ছাত্র রাজনীতির কথাই সেদিন উঠে এসেছিল তাঁর ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, এখন একটুতেই ছাত্র রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে। সম্মেলনের প্রথম সারিতেই বসেছিলেন শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। কী তাঁর পরিচয়? তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় হল যোগমায়া দেবী কলেজে যখন তিনি অধ্যাপনা করতেন, তখন সেখানকারই ছাত্রী ছিলেন মমতা। তাঁকে বিস্মৃত না হয়ে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই শিবরঞ্জনবাবুর কথা তুলে ধরেই মমতা বলেছিলেন, উনি আমার শিক্ষক। ক্যাম্পাসে যখনই দু’পক্ষের তর্ক-বিতর্ক হত, তখন শিবরঞ্জনবাবু মাঝে দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে দুপক্ষকে সামলাতেন।
অর্থাৎ একটা জিনিস পরিষ্কার, ছাত্র রাজনীতি যে ক্রমশ বেলাগাম হয়ে উঠছে, এবং তা জেনেবুঝেও তাকে পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না, তা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই অনুধাবন করতে পারছেন। ছাত্রদের মধ্যে সেই শিষ্টাচার, ভদ্রতা, শিক্ষককে সম্মান জানানো প্রভৃতি যেন ক্রমেই অতীত হয়ে উঠছে। বাম আমলেই অবশ্য এই অধঃপতনের সূত্রপাত। কলেজে কলেজে ঘেরাও, বিক্ষোভ, মারধরের মতো জঙ্গি কার্যকলাপের পাশাপাশি স্কুলের পরিচালন কমিটি দখলের জন্য ন্যক্কারজনক রাজনীতির আমদানি ঘটিয়েছে তারাই। দুঃখের হল, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তারাই আজ কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। একদা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএফআই যে ভয়ংকর একাধিপত্যের মাধ্যমে দখলদারি এবং নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি কায়েম করেছিল, তা যেমন মানুষ ভুলে যায়নি, তেমনি পরিবর্তনের জমানায় সেই জায়গা যেভাবে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নিয়েছে, তা দেখেও আজ শিক্ষাদরদি মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কারণ, আর যাই হোক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তো আর কলকারখানার সঙ্গে এক করে ফেলা যায় না। এখানে শিক্ষক হলেন আচার্য। তাঁর অধীনেই একজন ছাত্র যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের কারিগর, আগামী দিনের আলোকবর্তিকা। সেই সম্পর্ক যখন তুচ্ছ কারণে এবং স্বার্থান্বেষী মহলের দাদাগিরিতে খান খান হয়ে যায়, তখন একজন শিক্ষানুরাগীর মনে যে কষ্ট হয়, তা একমাত্র তিনিই বোঝেন।
গ্রামের স্কুল-কলেজের কিছু স্মৃতি নানা উত্থান-পতনেও মুছে যায়নি। সেই সময় যাতায়াত বলতে হেঁটে, অথবা সাইকেলে। মনে পড়ে, হেঁটে যাতায়াতের পথে সামনে শিক্ষক যদি কোনওভাবে এসে যান, তাহলে ভয়ে কোথায় মুখ লুকানো যায়, সেটাই ছিল ছাত্রদের প্রথম চেষ্টা। আর সাইকেল নিয়ে শিক্ষকদের সামনে দিয়ে গড় গড় করে বেরিয়ে যাওয়া তো ভাবাই যেত না। সামনে শিক্ষক দেখলে সাইকেল থেকে নেমে তাঁকে সম্মান জানানোটাই ছিল দস্তুর। এমনও অনেক শিক্ষককে দেখেছি, ক্লাসরুমে ঢুকলে বুকের ভিতর দপদপানি শুরু হয়ে যেত। হাঁটা, চলা, গাম্ভীর্যে ভরা কথাবার্তায় তাঁর সামনে যেন মাথা তোলার ক্ষমতা থাকত না।
হ্যাঁ, সেই সময়ও যে ছাত্রদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা ঢোকেনি, তা নয়। তবে ইউনিয়ন নামক এক বস্তুর মাধ্যমে ছাত্রসমাজের একটা বড় অংশ এভাবে অমানবিকতার পাঁকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েনি। তাই তো শিক্ষার সঙ্গে জড়িত নয়, এমন ইস্যুতেও ঝামেলায় পঠনপাঠন বিঘ্নিত হচ্ছে। তার উদাহরণ হল দুদিন আগে হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের শোভারানি কলেজের ঘটনা। চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মীর পদোন্নতি নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, স্রেফ এই অভিযোগ তুলে সেখানে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। দু’ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ চলার পর অধ্যক্ষের অনুরোধেও বরফ গলেনি। অবশেষে মুচলেকা দিয়ে পার পেতে হয়েছে তাঁকে।
অনেকেই বলেন, তৃণমূল আমলে ছাত্র রাজনীতির সুবাদে ঘেরাওয়ের ঘটনা কিছুটা হলেও কমেছে। যদি সত্যিই কমে থাকে, তা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, সদিচ্ছা থাকলে তাকে কি সমূলে বিনষ্ট করা যায় না? অথচ ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজ্যে এমনই পরিস্থিতি তৈরি হল যে সরকার তা দীর্ঘ সময় পিছিয়ে দিতে বাধ্য হল। নির্ধারিত সময়ে তা করার মতো বল-ভরসাই পেল না। শিক্ষা বিলেও সাহস করে এমন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে পারল না, যাতে দলতন্ত্র এবং ক্ষমতাসীন দলের ছড়ি ঘোরানোর পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। আগেরবার বিলে বলা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানের মাথায় শিক্ষাবিদদের রাখা হবে। এটি যথেষ্ট প্রশংসনীয় পদক্ষেপ বলে তখন অনেকেই প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, সংশোধনী এনে আরাবুলদের মতো নেতাদের আধিপত্য কায়েম করার রাস্তাই প্রশস্ত করে দেওয়া হল।
বায়োমেট্রিক হাজিরা নিয়েও কম ঝামেলা চলছে না। বহু শিক্ষক যে এটা চাইবেন না, তা বলাই বাহুল্য। আর তাঁদের মুখরক্ষাতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে আপাতত পিছিয়ে এসেছে। অথচ এরই মাঝে হরিহরপাড়ার স্বরূপপুর হাইস্কুল নিজেরাই এই পদ্ধতি চালু করে দিয়েছে। হায়দরাবাদ থেকে যন্ত্র এনে এবং বহরমপুর থেকে প্রশিক্ষিত কর্মী এনে তা বসানো হয়েছে। এখানে যে বাধা আসেনি, তা নয়। কিন্তু এই ধরনের যন্ত্র বসানোর ব্যাপারে অনড় ছিল কমিটি। যা নিয়ে সরকার ইতস্তত করছে, তা একটি প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল করে দেখিয়ে দিল, এ তো বলাই যায়। মুর্শিদাবাদ জেলার ৫০টি স্কুলেও তা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) জানিয়েছেন। এটাকে তাঁরা দৃষ্টান্ত হিসাবেই দেখছেন।
দৃষ্টান্ত আরও রয়েছে। শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়েই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে একটা আত্মিক যোগ দীর্ঘদিনের। বাইরের কোলাহল, বৈভব, ভোগসর্বস্ব জীবনযাত্রা এবং অহরহ অশান্তির মধ্যেও এ যেন এক অন্য জগৎ। পাঁচিলের বাইরে এক জীবন, ভিতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মহারাজদের কড়া নজরদারি আর নিয়মশৃঙ্খলার জাঁতাকলে হস্টেলের জীবনে কোনও ট্যাঁ ফো করার সুযোগ নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রুটিন যেন সেনাবাহিনীকেও হার মানাবে। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক যেন পিতা আর পুত্র। জিনস-এর যুগেও অল্পবয়সি থেকে তরুণ বা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছাত্ররা কেমন অবলীলায় ধুতি পরে আর উত্তরীয় গায়ে চাপিয়ে সকাল-সন্ধ্যা প্রার্থনায় ডুবে যাচ্ছে। শিক্ষক বা মহারাজদের মুখোমুখি হলে আপনা থেকেই শরীরটা যেন তাঁদের পায়ের উপর ঝুঁকে পড়ে। একটা দিন ঘুরে বেড়ালে যে কারোরই মনে হবে, মনপ্রাণ দিয়ে চাইলে অনেক কিছুই আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা যায়।
উল্লেখ্য, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধীনে রয়েছে পঞ্চম শ্রেণি থেকে কলেজ, এমনকী স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম। সব ছাত্রেরই থাকার হস্টেল। দৃষ্টিহীনদের জন্য আলাদা স্কুল ও হস্টেল। খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, অডিটোরিয়ামসহ লোকশিক্ষা পরিষদের আলাদা বিরাট ইউনিট। এতবড় একটা প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে চলে আসছে দীর্ঘদিন। অথচ রাজনীতির দৌড় তাদের গেট পর্যন্তই। না ছাত্র, না কর্মী, ভিতরে কোথাও তার প্রবেশাধিকার নেই। নেই শিক্ষক বা অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে জঙ্গি আন্দোলন, তাঁদের হেনস্তা, অপমান। নেই কথায় কথায় স্কুল বন্ধ, গেটে তালা পড়ার মতো ঘটনা। শুধু এখানে কেন, এখনও রাজ্যে বহু বেসরকরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে বাইরের হাওয়া ঢোকাই বারণ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকদিন আগেই ঘোষণা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্কৃতি মেনে বিশ্বভারতী থেকে মিনিট তিনেকের দূরত্বে ‘গীতবিতান’ উপনগরীতে বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলবেন। এই ধরনের উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। তবে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে গোটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা বলা কঠিন। তবুও শুরুটা তো হোক। ইচ্ছা থাকলে উপায় হবেই।
হোম
Uncategorised শিক্ষক নিয়োগ: সরকারি টালবাহানায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে পড়াশোনার, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে