বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০১৬ (সিপিআই) অনুযায়ী দুর্নীতি কমে দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। তালিকায় নিম্নক্রম অনুযায়ী ১৭৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম, যা গত বছরে ১৬৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা ছিল ১৩তম। এটা স্বস্তির ব্যাপার যে দুর্নীতি বাড়েনি, সামান্য হলেও কমেছে। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেছে এটা বলা যাবে না।
গত বুধবার রাজধানীতে এ সংক্রান্ত তথ্য সংবলিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি জানায়, ২০১২ সালেও এই জরিপে বাংলাদেশের স্কোর ২৬ ছিল। এ হিসাবে বলা যায় বাংলাদেশের দুর্নীতির পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উল্লিখিত সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শুধুমাত্র আফগানিস্তানের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। নিম্নক্রম অনুযায়ী ১৭৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ২য়- এই চিত্র নিয়ে কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রগতি হচ্ছে, কিন্তু দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। টিআইবি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাংলাদেশের আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি-কাঠামো তুলনামূলকভাবে সুদৃঢ়তর হয়েছে এই ধারণা থেকে সূচকে বাংলাদেশের স্কোর এক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ঘাটতির কারণে আরো ভালো করা যায়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি আইনের শাসন এবং জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে কোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে জবাবদিহির জন্য শক্তিশালী দাবি উত্থাপনে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি সংস্থাসহ আপামর জনগণের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরির তাগিদ জানিয়েছে টিআইবি।
বাংলাদেশে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বিদ্যমান। এটা দেশের নাগরিকরা তাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায়ই টের পান। এটা বলার কোনো জরিপ বা কোনো সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজন হয় না। অবশ্য যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা এ সংক্রান্ত জরিপ নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তোলেন। এই টিআইয়ের জরিপ নিয়েও একই ব্যাপার দেখা গেছে। টিআইয়ের জরিপের হিসাব-নিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, মাত্রার হেরফের হতেই পারে, তবে জরিপ থেকে মোটাদাগে যে সত্য বেরিয়ে আসে তাকে আমলে নিলেই বরং আমাদের জন্য মঙ্গল। এটা সত্যি যে, বর্তমান সরকার দুর্নীতি দমনে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারি কাজে ডিজিটালাইজেশনের কিছু সাফল্য এসেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। দুদকের বেশকিছু সাহসী উদ্যোগ দেখেছি আমরা। এতদসত্ত্বেও দুর্নীতি নির্মূলে কাক্সিক্ষত উন্নতি হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। টিআইয়ের জরিপ দেখিয়েছে যে, আমাদের দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই বরং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হবে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের রূপরেখা প্রকাশ করেছে সরকার। সরকারের এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হলে দুর্নীতির লাগাম টানতেই হবে। দুর্নীতির শিকড় সমূলে উপড়ে ফেলতে হলে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক একটি কার্যক্রম চালাতে হবে। দুর্নীতিবাজ যতই শক্তিশালী হোক না কেন তার বা তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো কার্যকর করতে হবে, সরকারের নীতি-কাঠামো দুর্নীতির রন্ধ্রমুক্ত করতে হবে। সর্বত্র একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলেই দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সর্বোপরি দুর্নীতিবিরোধী একটি পরিবেশ সৃষ্টিতেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে যার যার অবস্থান থেকে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী যেরকম জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন, তেমনি দুর্নীতির ব্যাপারেও জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করতে হবে। উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এর বিকল্প নেই।
সূ্ত্রঃ ভোরের কাগজ