পুলিশকে আরও মানবিক আচরণ করতে হবে-পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হকের এই আহ্বান কি বাহিনীটির কর্মীদের কানে গেছে? পুলিশ সপ্তাহ চলাচালেই রাজধানীতে থানার চত্বরে সাংবাদিকের ওপর যেভাবে হামলে পড়েছে পুলিশ, নির্বিষ হরতালে কর্মসূচির পক্ষে থাকা রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর যেভাবে তারা হামলা করেছে তাতে পুলিশের অতি আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাতিলের দাবিতে তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আধাবেলা হরতাল চলাকালে পুলিশের হামলায় আহত হয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার, পরিবেশ কর্মী মিজানুর রহমান এবং দুই সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন। এদিন পুলিশ হরতাল আহ্বানকারীদের উপর টিয়ারসেল এবং রাবার বুলেট ছোড়ে করে। সাংবাদিকরা পুলিশের এমন হামলার ছবি তুলতে গেলে পুলিশ তাদের উপরও হামলা করে।
সংবাদ কর্মী আবদুল আলিমকে মারধর এবং পরিবেশ কর্মী মিজানুর রহমানকে মেরে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এটিএন নিউজের এসোসিয়েট হেড অব নিউজ প্রভাষ আমিন তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে লিখেন, ‘এটিএন নিউজের ক্যামেরাপারসন আব্দুল আলিমকে পুলিশ শাহবাগ থানার ভেতরে নিয়ে পেটাচ্ছিল। বাধা দিতে গেলে রিপোর্টার ইশান দিদারকেও পিটিয়েছে পুলিশ। ২০/৩০ জন পুলিশ মিলে এই দুই সাংবাদিককে বেধড়ক পিটিয়েছে। এখন তাদের ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে। আমাদের ক্যামেরাম্যান বা রিপোর্টার যদি বেআইনি কিছু করে থাকে, পুলিশ তাদের আটক করতে পারতো। এমনও নয় রাস্তায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝখানে পড়ে তারা মার খেয়েছে। ঠান্ডা মাথায় থানার ভেতরে নিয়ে ২০/৩০ জন মিলে দুই জন নিরস্ত্র সাংবাদিককে পিটিয়েছে। কেন? এই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই চাই।’
সাংবাদিক মানিক মুনতাসির লিখেন, ‘শিয়রে ফনা তুলে আছে ৫৭ ধারা। আমি কিছু বলিব না। নিপাত যাক এই হিংস্রতা আর অতি উৎসাহ, উদ্দীপনা। আমি কিছু বলিব না।’
আইজিপি যেদিন পুলিশকে মানবিক হতে বলেছেন, ঠিক সেদিনই রাজধানী লাগোয়া গাজীপুরে আটকের ভয় দেখাতে গিয়ে এলাকাবাসীর কাছেই আটক হন তিন পুলিশ কর্মকর্তা। এই ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরির্দশক খায়রুল ইসলাম ও সহকারী উপ-পরিদর্শক মাহবুবকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
পুলিশের আচরণ নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। বাহিনীটির শীর্ষ কর্মকর্তারা বারবার সদস্যদের পরিশীলিত হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, বলছেন, অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োগ হলে শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি হচ্ছেও মাঝেমধ্যে, তবু অভিযোগের শেষ নেই।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, উন্নত দেশে পুলিশ জনগণের সাথে সবসময় বন্ধুত্ব্পূর্ণ আচারণ করে কিন্তু আমাদের দেশে পুলিশের এমন আচারণ সব সময় প্রশ্নের মুখে পড়ে। তারা সহনশীল আচারণ না করে সব সময়ই উদ্ধৃতপূর্ণ আচারণ করে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্বে যে পুলিশ বাহিনী নিয়োজিত তাদের কিছু সদস্যের আচার-আচারণ শুধু পুলিশের ভাবমর্যাদাই নষ্ট করেনি, পারত পক্ষে তাদের ধারে কাছেও ভিড়তে চায় না সাধারণ মানুষ।
শাহবাগের সাংবাদিককে পিটুনি এবং একজন প্রবীণ লোকের গায়ের পোশাক ছিড়ে তাকে চ্যাং দোলা করে তুলে নেয়ার ঘটনায় বিব্রত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যরাই আজকের এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’
তেল-গ্যাস ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘পুলিশের এই আচরণ কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। আমি মনেকরি সরকারের উপরের মহলের ইশারায় এ হামলা হয়েছে। আমাদের লোকেদের থানার ভিতরে নিয়ে যাওয়ার সময় ছবি তুলতে গিয়েছিল সাংবাদিক এসময় তাকেও মারধর করে। এ হামলায় সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সবার আছে। কিন্তু প্রতিবাদ মোকাবেলায় যে আচরণ করেছে সেটা ন্যাক্কারজনক। আমরা পুলিশকে পেটোয়া বাহিনী হিসাবে দেখতে চাই না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পুলিশের নিয়োগ বদলি এবং পদোন্নতি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কথা নানা সময় উঠে আসছে। দেখা যায় এব কারণে পুলিশের মধ্যে নিয়মনীতি মানার কোন তোয়াক্কা করা হয় না।’
জনাব মারজান আরও বলেন, ‘বিদ্যামান পুলিশ আইনে পুলিশকে মানবিক করা যাবে না। কারণ পুলিশ চলছে ১৮৬১ সালের আইনে। যে আইনটি বৃটিশরা করেছিল এ অঞ্চলের মানুষকে শোষণ করার জন্য। যতদিন এ আইন পরিবর্তন করার যাবে না ততদিন পুলিশ এমন অমানবিক আচরণ করবে। এ আইন পরিবর্তন করে পুলিশকে বাহিনীর বদলে সেবাদাতায় পরিণত করতে হবে।’
তবে অন্যায্য বা অন্যায় আচরণ করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয় না, এমনটা নয়। গত ছয় বছরে ৭৬ হাজার পুলিশকে নানা ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এই হিসাবে দেশের প্রতি দুই জনের একজনই বাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কোনো না কোনো সাজাপ্রাপ্ত।
পুলিশ সদরপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গত ছয় বছরে সাজা পাওয়া পুলিশের মধ্যে লঘুদণ্ড পেয়েছেন ৭১ হাজার ৭৭০ জন। গুরুদণ্ড পেয়েছেন চার হাজার ৩৩ জন। বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ৬২৩ জনকে। ৭৬ পুলিশ সদস্য আবার সরাসরি ফৌজদারি অপরাধেরও আসামি। আদালতে তাদের বিচার চলছে।
যারা গুরুদণ্ড পেয়েছেন তাদের মধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ৫৫১ জনকে।
লঘুদণ্ডের মধ্যে আছে, তিরস্কার। আর গুরুণ্ডের মধ্যে পড়ে বেতন কাটা, তাৎক্ষণিক বদলি, বাধ্যতামূলক অবসর বা চাকরিচ্যুতি।