দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেহাল দশা বিরাজ করছে। একদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা কম, অন্যদিকে রোগীর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে সুনামধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা আরও কম। নিয়মের বেড়াজালে শুরুতেই সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পান না। যেতে হয় চেম্বারে। এতে বাধ্য হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে পড়ছে রোগীদের লম্বা লাইন। বাধ্য হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অনেক রোগী দেখেন। রোগীকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। তড়িঘড়ি করে দেখায় চিকিৎসকের প্রতি অসন্তুষ্ট হচ্ছেন ও আস্থা রাখতে পারছেন না রোগীরা। ফলে সামর্থ্যবান রোগী চলে যাচ্ছেন বিদেশে। এতে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে উচ্চ ফি, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার বিপরীতে কমিশন, ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন, উপহার ও নানা ধরনের সুবিধা নেওয়া, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ লেখা ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করানোর অভিযোগ রয়েছে। এতে একদিকে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সন্তোষজনক সেবা পাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব এ বিষয়ে বলেন, দেশে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, কিন্তু তারা প্রচারে নেই, যে কারণে রোগীরা তাদের নাম জানেন না। হাতেগোনা কিছু চিকিৎসকের নাম জানেন রোগীরা, তাদের কাছেই যাচ্ছেন। ফলে কিছু পরিচিত ডাক্তারের চেম্বারে বেশি ভিড় পড়ছে। এ জন্য রোগীদের আগে খোঁজখবর নিতে হবে। তারপর ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রচলিত নিয়মের কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোয় শুরুতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাক্ষাৎ পান না রোগীরা। কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে তারপরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় উচ্চ ফি দিয়ে রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা নিচ্ছেন। কিন্তু এত ব্যয়বহুল সেবা নেওয়ার সক্ষমতা অনেকেরই নেই। ফলে তারা বাধ্য হয়ে চেম্বারে যোগাযোগ করছেন। সেখানে পাওয়া সেবায়ও রোগীরা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।
পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তাদের সিরিয়াল পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রায় ১৩ মাস অপেক্ষা করে এক রোগী খ্যাতিমান এক কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়ার নজিরও রয়েছে। এ ছাড়া ৩ মাস অপেক্ষা করার ঘটনা তো অহরহ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ফি বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১ হাজার টাকা। কয়েকজন চিকিৎসক ফি নিচ্ছেন দেড় হাজার টাকা। বাকি কিছু ডাক্তার ফি নিচ্ছেন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এই ফি দিয়েও একজন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রোগী তার সমস্যার কথা বলতে পারছেন না। ডাক্তার সামান্য একটু শুনেই ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছেন। ফলে রোগীর মধ্যে সন্তুষ্টি আসছে না। এ ছাড়া প্যাথলজিক্যাল বিভিন্ন পরীক্ষার বিপরীতে ডাক্তাররা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ কমিশন নিচ্ছেন। এ কারণে বেশি মাত্রায় প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লেখার বিপরীতে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ডাক্তাররা পাচ্ছেন কমিশন, উপহারসহ নানা সুবিধা। ডাক্তাররা রোগীর বিপরীতে বেশি সংখ্যক ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। এতে রোগীর চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে রেফারেল সিস্টেম চালু না থাকায় রোগীরা চাইলেও একজন সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপকদের নাগাল পান না। এ কারণে রোগীরা সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপকদের কক্ষে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করলে তারা বিরক্তি প্রকাশ করেন। রোগীরা বাধ্য হয়ে এসব চিকিৎসকের সেবা পেতে ছুটে যান প্রাইভেট চেম্বারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রচুর পরিমাণ রোগীর সমাগম থাকলেও চিকিৎসাসেবা হয়ে পড়েছে অনেকটাই প্রাইভেট চেম্বারকেন্দ্রিক। সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের প্রায় ৯০ ভাগ চিকিৎসক কোনো না কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কিনিক বা ব্যক্তিগত অফিস ভাড়া নিয়ে রোগী দেখেন। এ প্রাইভেট প্রাকটিসের লোভে ঢাকায় কর্মরত ডাক্তার মফস্বলে যেতে চান না। রোগীরাও সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাগাল না পেয়ে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার আশায় ধারদেনা করে কিংবা সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নিতে ভিড় করেন। কোনো কোনো চিকিৎসক সরকারি চাকরির পাশাপাশি নিজস্ব ব্যক্তিগত এক বা একাধিক চেম্বারে বসেন। এমন চিকিৎসকও আছেন যিনি দিনে একশর বেশি রোগী দেখেন। কোনো চিকিৎসক প্রথমবারের ফি ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। দ্বিতীয়বার (১ মাসের মধ্যে) ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক রিপোর্ট দেখাতেও টাকা নিচ্ছেন। এরপরও ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম মিরপুরের কিডনি ফাউন্ডেশনের এক অধ্যাপককে দেখানোর আশায় ২০১৫ সালের জুন মাসে সিরিয়াল পেতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের চেম্বারে যোগাযোগ করলে প্রায় ৩ মাস পর তাকে সিরিয়াল দেওয়া হয়। সিরিয়ালের তারিখ মতো রোগী ওই চিকিৎসকের চেম্বারে গেলে তাকে জানানো হয় চিকিৎসক বিদেশে থাকায় সিরিয়াল বাতিল হয়ে গেছে। তাকে আবার নতুন করে সিরিয়াল দিতে হবে। আনোয়ারা বেগম আবার সিরিয়াল পান ৩ মাস পর। ওইদিনও চিকিৎসকের চেম্বারে যোগাযোগ করা হলে বলা হয় সরকারি ছুটি থাকায় তার সিরিয়াল বাতিল। এরপর আবার সিরিয়াল নেন আনোয়ারা বেগম। এবারও চিকিৎসক বিদেশে থাকায় তার সিরিয়াল বাতিল। এক বছরের বেশি সময় অপেক্ষার পর ২০১৬ সালের অক্টোবরে ওই চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পান আনোয়ারা বেগম। আনোয়ারা বেগমের স্বজন বলেন, আত্মীয়স্বজনের পীড়াপীড়িতে কিডনি ফাউন্ডেশনের অধ্যাপককে দেখানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে এক বছরের বেশি সময়। রোগী দেখার পর চিকিৎসক যেসব টেস্ট দিয়েছেন সেই রিপোর্ট দেখাতে আবার তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। রোগীর ক্রিটিক্যাল মুহূর্তেও সিরিয়াল পেতে কোনো ছাড় পাওয়া যায় না। এটি গেল শুধু এক রোগীর কথা, এ রকম হাজার হাজার নজির রয়েছে। যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে গিয়ে নানাভাবে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক অধ্যাপক রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে বসেন। প্রতি রোগীর কাছ থেকে ফি নেন ১ হাজার টাকা এবং রিপোর্ট দেখাতে ৭০০ টাকা। কিন্তু তার সিরিয়াল পেতে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ৩ মাস। ওই চিকিৎসক রাত ২টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। এর মধ্যে ছোটাছুটি করেন বিভিন্ন হাসপাতালে। ফলে রোগীরা সেবা না পেয়ে বিরক্ত।
বারডেম হাসপাতালের এক অধ্যাপক বসেন ল্যাবএইডে। তিনি রোগীর কাছ থেকে ফি নেন ১ হাজার টাকা। আবার রিপোর্ট দেখাতেও টাকা নেন। রোগী দেখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় দেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক অধ্যাপক রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে বসেন। তিনি রোগীর কাছ থেকে ১ হাজার টাকা ফি নেন। রোগীরা তার চিকিৎসায় উপকৃত হলেও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ওই চিকিৎসককে দেখানোর পর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এক রোগী বলেন, ১ হাজার টাকা ফি নিয়েও তিনি রোগীর কথা শুনছেন না। সামান্য একটু শুনেই ব্যবস্থাপত্র ধরিয়ে দিচ্ছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক অধ্যাপক রাজধানীর মগবাজার এলাকার একটি হাসপাতালে সপ্তাহে ৪-৫ দিন রোগী দেখেন। তার সিরিয়াল পেতে প্রায় ৩ মাস অপেক্ষা করতে হয়। তার চিকিৎসায় রোগীদের অনেকেই সুস্থ হচ্ছেন; কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে রোগীর কেসহিস্ট্রি গ্রহণের ক্ষেত্রে। তিনি রোগীর কেসহিস্ট্রি শোনা ও প্রেসক্রাইব করতে স্বল্প সময় নেন। চাঁদপুরের এক রোগীর স্বজন জানান, এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা ওই চিকিৎসককে রোগী দেখাই। কিন্তু তিনি রোগীর সমস্যা শোনার সময় দেন কম। তাড়াতাড়ি সমস্যার কথা বলতে গিয়ে অনেক সময়ই সব কিছু বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। চেম্বার থেকে বেরিয়ে মনে হয় অনেক সমস্যার কথা বলা হয়নি।
২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হওয়ার আগ মুহূর্তে ফেরত আসে। এরপর ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তা হয়নি। এরপর বর্তমান মতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের প্রথম দফার শাসনামলে আইনটির খসড়া প্রণীত হয়। কিন্তু তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমান সরকার ওই আইনটি বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন-২০১৬ নামে প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।