রিজার্ভের চুরি যাওয়া বাকি অর্থ ফেরত দেবে না ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি)। ব্যাংকটির পক্ষ থেকে গতকাল এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলার কারণেই তাদের রিজার্ভের অর্থ চুরি গেছে। উল্লেখ্য, এই ব্যাংকের মাধ্যমেই চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে।
রিজাল ব্যাংক এমন এক সময়ে এই বিবৃতি দিল, যখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল অর্থ উদ্ধারে ফিলিপাইনে রয়েছে। আর এরই মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে গত সোমবার বাংলাদেশ দলের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সভা বাতিল করে দেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের মুখপাত্র আর্নেস্তো অ্যাবেলা এ নিয়ে বলেছেন, বৈঠকে প্রেসিডেন্টের ওপর তাৎক্ষণিকভাবেই মনোযোগ দেওয়ার চাপ থাকতে পারে বলে তা বাতিল করা হয়েছে। ফিলিপাইনের দৈনিক পত্রিকা ইনকোয়ারার এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
এ অবস্থায় রিজার্ভের চুরি হওয়া অর্থের সিংহভাগ অংশ ফেরত পাওয়ার আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। চুরি হয়ে ফিলিপাইনে চলে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি ডলার এরই মধ্যে ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাকি প্রায় সাড়ে ৬ কোটি ডলার আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া রিজাল ব্যাংক বিবৃতিতে চুরির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করতেও বলেছে। ফলে অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পদক্ষেপ সঠিক ছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ব্যাংকের পক্ষে বিবৃতিটি দিয়েছেন তাদের আইনজীবী (কাউন্সেলর) থিয়া দায়েব। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাবধানতার কারণেই তাদের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়েছে। এ ঘটনার দায় আরসিবিসি নেবে না। চুরি যাওয়া ওই অর্থ উদ্ধারের জন্য ম্যানিলায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ ‘অন্যায্যভাবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে’ ফিলিপাইনের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন।
থিয়া দায়েব ওই বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলার কারণেই তাদের রিজার্ভের অর্থ চুরি গেছে। তাই তারা যেন স্বচ্ছতা দেখায়, আমরা সেই আহ্বান জানাই। ফিলিপাইনের সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ঘটনায় সহায়তার জন্য অনেক কিছু করেছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককেই খুঁজে বের করে দেখাতে হবে আসলে কারা ওই অর্থ চুরি করেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে কোনো অর্থ দেওয়ার পরিকল্পনা আরসিবিসির নেই। বরং চুরির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশ নিজস্ব তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করুক।’
এদিকে ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ গত সোমবার ফিলিপাইনের ডেইলি ইনকোয়ারারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের কাছে অর্থ দাবি করব।’ সিনেটের কিছু শুনানিতে তারা জানিয়েছিল, তাদের দোষ প্রমাণ হলে তারা বাংলাদেশকে পাঁচ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত। ক্ষতিপূরণের এ পরিমাণ তারাই পরিষ্কারভাবে জানিয়েছিল। পত্রিকাটি বলছে, মূলত এই সাক্ষাৎকারের জের ধরেই বিবৃতিটি দিয়েছে আরসিবিসি।
রিজাল ব্যাংকের এই বিবৃতি প্রসঙ্গে আনিসুল হক গতকাল ইনকোয়ারারকে বলেছেন, বিবৃতিটি অপ্রাসঙ্গিক। এটা প্রমাণিত যে রিজাল ব্যাংক তাদের হিসাবে অর্থ গ্রহণ করেছে। যার জন্য তাদের জরিমানা গুনতে হয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘসূত্রতা ও ঘটনার বিচার না হওয়ায় তারা এসব সুযোগ নিচ্ছে। তারা মূলত বাংলাদেশের দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়েই চালাকি করছে। বাংলাদেশে এ ঘটনার তদন্ত হলেও প্রকাশ হয়নি, কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। ফলে নানা রকম জল্পনাকল্পনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এতে দেশটি নিজেদের ব্যাংকের সুনামের স্বার্থেই টাকা ফেরত দেবে।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে আইনমন্ত্রী ছাড়া আরও রয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান।
গতকাল রাতে ফিলিপাইনের ইনকোয়ারার আরও জানিয়েছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনার নতুন করে শুনানি করতে ফিলিপাইনের সিনেটের কাছে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। সিনেটের সভাপতি একুইলিনো কোকো পিমেন্টেলের সঙ্গে সভা করে এ দাবি জানিয়েছে প্রতিনিধিদল। সভা শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আমরা ফিলিপাইন সরকারের কাছে বাকি অর্থ ফেরত দিতে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেছি। পিমেন্টেল আমাদের নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।’
জানা গেছে, প্রতিনিধিদলটির ফিলিপাইনের আইনমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, সিনেটের চেয়ারম্যান ও গভর্নরের সঙ্গে সভা করার কথা রয়েছে। ১ ডিসেম্বর রাতে ফিলিপাইন ছাড়বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা গতকাল রাতে এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিজাল ব্যাংককে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরিমানা করেছে। ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁরা নিয়ম না মেনে হিসাব খুলেছেন, অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছেন। এসব প্রমাণিত হয়েছে। ফলে এখন দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংকটির আইনজীবী নিজের মতো বিবৃতি দিয়েছেন। আমরা এখনো বাকি অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে আশাবাদী।’
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (নিউইয়র্ক ফেড) রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কায় আর বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে। শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত পাওয়া গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। চুরি হওয়া অংশের ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার ফিলিপাইন থেকে ফেরত পাওয়ায় বাকি থাকল আরও ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। এ ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে আরসিবিসি ব্যাংককে ২ কোটি ১০ লাখ ডলার জরিমানা করে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চুরির এ ঘটনায় আরবিসির ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল মামলা করেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনের নির্দেশ: এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করে সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। গতকাল মঙ্গলবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের তৈরি করা এ-সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ না করায় কমিটির বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শওকত আলী সাংবাদিকদের বলেন, কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি–সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদনটি চেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রতিবেদন তাদের কাছে নেই। অর্থমন্ত্রীর কাছে আছে। তিনি সেটা প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না। কমিটি বলেছে, অর্থমন্ত্রী দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কিন্তু সংসদ এবং সংসদীয় কমিটিকে তো সেটা দেখাতে হবে। সে জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিবেদনটি সংগ্রহ করে কমিটির আগামী বৈঠকে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গত ৩০ মে তদন্ত রিপোর্ট অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছে।
শওকত আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য সুবিদ আলী ভূঁইয়া, আবদুর রউফ ও নাভানা আক্তার অংশ নেন।