ঋণঝুঁকি কমাতে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। কিন্তু আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে মুনাফা দিয়েও তা কুলাচ্ছে না। এর ফলে বড় অঙ্কের প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়েছে এই ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে এ ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকেরই প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতির প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানতগ্রহণ করে তার একটি অংশ ব্যাংকগুলোকে সংরক্ষণ করতে হয়, যাকে ব্যাংকিং ভাষায় এসএলআর বলে। আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এ অর্থ রাখা হয়। বাকি অর্থ ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে থাকে। কিন্তু ব্যাংক যাদের কাছে বিনিয়োগ করে তারা ঋণ ফেরত না দিলে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য খেলাপি ঋণের প্রকার ভেদে বিভিন্ন হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় মুনাফা থেকে। কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। আর মূলধন ঘাটতি হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওই ব্যাংক বছর শেষে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।
সাধারণত কোনো ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হলে ওই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর সন্দেহজনক খেলাপি হলে ৫০ ভাগ ও নিম্নমানের খেলাপি হলে ২০ ভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ করার মতো পর্যাপ্ত আয় ছিল না। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোই পুরো ব্যাংকিং খাতকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী, রূপালী, বেসিক ও কৃষি ব্যাংক রয়েছে। পরিসংখ্যান মতে, সোনালী ব্যাংকের আট হাজার ৫৬১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে সাত হাজার ৪৯৩ কোটি টাকাই কুঋণ, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৮ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ৮৮ ভাগই কুঋণ। অর্থাৎ তিন হাজার ২৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে দুই হাজার ৬৭২ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। আর বেসিক ব্যাংকের ৯৮ ভাগই মন্দ ঋণ। ব্যাংকটির আলোচ্য সময়ে ছয় হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ছয় হাজার ৬৫৪ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। অপর দিকে কৃষি ব্যাংকের চার হাজার ৮৪১ কোটি কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে চার হাজার ৩১ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ফলে প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়েছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিপরীতে পাঁচ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে চার হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে এক হাজার ২৮ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে রূপালী ব্যাংক এক হাজার ৭৫৬ কোটি টাকার বিপরীতে সংরক্ষণ করেছে এক হাজার কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ৭৫৬ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের আলোচ্য সময়ে প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ১৯৬ কোটি টাকা।
সরকারি ব্যাংকগুলোর বাইরেও চারটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১৬৮ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ২৫৪ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৬৮ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ব্যাংক বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতকে ডুবাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। তাদের মতে, ব্যাংক খাতে সামগ্রিক প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া। আর খেলাপি ঋণ বাড়ার মূলে রয়েছে সঠিকভাবে ঝুঁকি পর্যালোচনা না করা। কোনো কোনো েেত্র ঋণ ঝুঁকি নীতিমালার অপব্যবহারও করে ব্যাংকগুলো। এ কারণে অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং সূচক ঋণাত্মক হয়ে পড়ছে। তারা বলেন, পরিস্থিতি উত্তরণে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতিই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবে।