আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক পদের জন্য উঠতি নেতাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে সহসম্পাদক পদে আগ্রহীদের জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করা হয়েছে।
দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, আগের কমিটির অধীনে গণহারে সহসম্পাদক নিয়োগ দেওয়ায় দলের মধ্যেই ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। এ কারণে এবার সহসম্পাদকের সংখ্যা ১০০-এর মধ্যে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের। আবার সহসম্পাদকের পদ বিলুপ্ত করে দেওয়ারও মত রয়েছে অনেক নেতার।
গত ২৮ অক্টোবর নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর প্রথম সভায় সহসম্পাদকের সংখ্যা কমানো হবে, নাকি বিলুপ্ত করা হবে—এই নিয়ে আলোচনা হয়। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সহসম্পাদকের পদ চালু করা হয় ২০০২ সালে। পরে তা দলের গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবার কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর থেকেই সহসম্পাদক পদের আগ্রহীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের পেছনে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করা হয়েছে। ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত তা জমা দেওয়া যাবে ধানমন্ডি কার্যালয়ে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, সহসম্পাদকের পদ বাদ দেওয়া হবে কি না—এমন কথা এসেছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সম্পাদকীয় পদ রয়েছে ১৯টি। এর বেশির ভাগই বিষয়ভিত্তিক। সে ক্ষেত্রে উপকমিটিও ১৯টি হওয়ার কথা। প্রতিটি উপকমিটিতে সর্বোচ্চ পাঁচজন করে সহসম্পাদক নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে মোট সহসম্পাদকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৯৫ জনের মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের গত কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন কতজন সহসম্পাদক ছিলেন, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির দুজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, গত কমিটির অধীনে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে সহসম্পাদকের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছিল। গঠনতন্ত্রে সহসম্পাদক নিয়োগের ক্ষমতা দলীয় সভাপতির। কিন্তু বিগত কমিটির একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সম্পাদকীয় পদে থাকা একজন নেতা গণহারে সহসম্পাদকের চিঠি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গঠনতন্ত্রে প্রতিটি সম্পাদকীয় বিভাগে একটি করে উপকমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। সভাপতিমণ্ডলী, উপদেষ্টা পরিষদ কিংবা কার্যনির্বাহী সংসদের একজন নেতা উপকমিটির চেয়ারম্যান হবেন। আর সংশ্লিষ্ট বিভাগের সম্পাদক হবেন ওই উপকমিটির সদস্যসচিব। সর্বোচ্চ পাঁচজন সহসম্পাদক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সদস্য, সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সংসদীয় কমিটির সভাপতিসহ কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে।
গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, উপকমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগের কার্যক্রম জোরদার করার কাজে সহায়তা করবে। বিভাগ-সম্পর্কিত তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ, সরবরাহ ও সংরক্ষণ করবে এসব উপকমিটি। পাশাপাশি তারা সময়ে সময়ে প্রতিবেদন তৈরি করবে। প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার উপকমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় নিজ নিজ উপকমিটি তাদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন ও করণীয় নির্ধারণ করবে।
তবে দলীয় সূত্র জানায়, দু-একটি উপকমিটি বাদে বাকিগুলোর বৈঠক হয় না বললেই চলে। দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান থাকলে টিভি ক্যামেরায় নিজের জানান দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকেন সহসম্পাদকদের অনেকেই। কারও কারও বিরুদ্ধে সচিবালয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি ও হুমকি-ধমকি দিয়ে ব্যবসা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৬ মে ধানমন্ডির একটি কমিউনিটি সেন্টারে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক প্রস্তুতি সভায় সহসম্পাদকদের আধিক্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের (তখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন)। তিনি বলেছিলেন, ‘উপকমিটির সহসম্পাদক ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়েছে। পার্টি অফিসের সামনে যার সঙ্গে ধাক্কা লাগে, সে-ই বলে আমি আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক। কিন্তু তারা যে উপকমিটির সহসম্পাদক, এটা তারা বলে না।’ তিনি বলেন, উপকমিটির সহসম্পাদকের সংখ্যা ১০০-এর মধ্যে কমিয়ে আনা হবে।
২০১২ সালের জাতীয় সম্মেলনের পর ৬৬ জন সহসম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের প্রভাবশালী কিছু সাবেক নেতাকে সহসম্পাদক করা হয়। একপর্যায়ে সহসম্পাদকের সংখ্যা ৪৬৫-তে পৌঁছায়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আরও বেশ কয়েকজনকে সহসম্পাদক করা হয়; যাঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী এবং বিদেশে থাকেন এমন ব্যক্তিও ছিলেন।
২০০২ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর ৬২ জন সহসম্পাদক নিয়োগ করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনের পর গঠিত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে কোনো সহসম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান (গোলাপ) প্রথম আলোকে বলেন, এবার সহসম্পাদকের পদ ১০০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। কবে নাম ঘোষণা করা হবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সময় বলা যাবে না। এক মাসেও হতে পারে। এক বছরও লাগতে পারে।’
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সহসম্পাদক পদটি কেন্দ্রীয় কমিটির অংশ না হলেও এর গুরুত্ব অনেক। কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দেওয়া যায়নি কিংবা ভবিষ্যতে আসতে পারেন, ছাত্ররাজনীতি শেষ করা তরুণ এবং বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান আছে—এমন নেতাদেরই সহসম্পাদক করার রেওয়াজ। দলের বক্তব্য মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য যেসব তথ্য-উপাত্ত দরকার, তা সংগ্রহ করার দায়িত্ব সহসম্পাদকের। এটা অনেকটা গবেষণামূলক কাজের মতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই সহসম্পাদকের পদটাকে তদবির ও ব্যবসার হাতিয়ার করে ফেলেছেন কিছু ব্যক্তি। এ জন্য কিছু জ্যেষ্ঠ নেতারও দায় আছে।
আগের কমিটিতে সহসম্পাদক ছিলেন—এমন একজন সাবেক ছাত্রনেতা প্রথম আলোকে বলেন, এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢোকার আশায় ছিলেন, কিন্তু সুযোগ হয়নি। এখন দুটি পথ খোলা আছে। এক. জেলায় গিয়ে রাজনীতি করা। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে সহসম্পাদক হওয়া। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে জেলার রাজনীতিতে একাত্ম হওয়া কঠিন। সহসম্পাদকের মধ্যে কেন্দ্রীয় একটা ভাব আছে।
সাবেক আরেকজন সহসম্পাদক বলেন, প্রতিটি উপকমিটিতে পাঁচজন করে সহসম্পাদক থাকলে কোনো দুর্নাম বা সমস্যা হতো না। কিছু কেন্দ্রীয় নেতা দল ভারী করার জন্য অবাধে সহসম্পাদক নিয়োগ দিয়েই নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছেন। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিচালক কিংবা অন্য দায়িত্ব পালনকারীদের সহসম্পাদক না দেওয়া উচিত। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে পদ আছে—এমন নেতাদের এ পদে রাখার যৌক্তিকতা নেই।