নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে বিএনপির ডাকে সরকারি মহলে কোনো সাড়া মেলেনি। সরকারি দল আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিক বিএনপির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর ১৪ দলের শরিক সংগঠনগুলোও একই মনোভাব দেখাচ্ছে। তবে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপির প্রস্তাব তুলে ধরার বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করছে।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এই নাকচ পরিস্থিতির মধ্যেও একধরনের স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে দলটি। মাঠের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়া বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনায় থাকতে চায়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের তাৎক্ষণিক জবাব, রাজনৈতিক মহলের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হওয়ায় দলটির শীর্ষ নেতারা খুশি। তাঁরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপির প্রস্তাব সরকার যে গ্রহণ করবে না, এটা সবাই জানে। কিন্তু সরকারের এই প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না, এর মধ্যে বিএনপি রাজনীতির সার্থকতা খুঁজছে।
নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়ার পরদিন শনিবার বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষ ইসি গঠনে আমি বিএনপির প্রস্তাবনা তুলে ধরেছি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইলে ক্ষমতাসীনরাও এর ভিত্তিতে আলোচনার সুযোগ নিতে পারে।’
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাব আওয়ামী লীগ নাকচ করলেও বিএনপি চায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকুক। এতে সরকার কিছুটা হলেও চাপে থাকবে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
গত শুক্রবার সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু করতে ১৩টি প্রস্তাবও তুলে ধরেন তিনি।
ওই দিনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার প্রতিক্রিয়ায় গতকাল শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া আগেই তৈরি ছিল। দলটি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত। জনমত উপেক্ষা করে তারা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়।
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও বিএনপি চায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা থাকুক। বিশেষ করে নাগরিক সমাজের মধ্যে এটা নিয়ে যুক্তিতর্ক অব্যাহত থাক। এ জন্য বিশিষ্টজনদের সঙ্গে প্রস্তাবটি নিয়ে মতবিনিময়, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের এই প্রস্তাব দেওয়া, জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ে এই বিষয়ে সভা-সেমিনারের আয়োজন এবং বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে সভা-সেমিনারের আয়োজন করার পরিকল্পনা আছে। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবটি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে দলটির।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির জন্যই তাঁরা সবকিছু বলেছেন। বিএনপি একটি প্রস্তাব দিয়েছে। যদি মনে হয় এটা ভালো হয়েছে, তাহলে এর ওপর ভিত্তি করেই সবকিছু এগোতে পারে।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত বিষয়টি আলোচনায় থাকলে সরকার একধরনের চাপে থাকবে। তারপরও ‘গ্রহণযোগ্য’ কমিশন গঠিত না হলে বিএনপি কথা বলার বা প্রয়োজনে আন্দোলনে যাওয়ার যৌক্তিক ক্ষেত্র থাকবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, পুরো প্রস্তাবটি সামগ্রিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে প্রত্যাখ্যান করাটা আওয়ামী লীগের উচিত হয়নি। এভাবে প্রত্যাখ্যান না করে সরকারের উচিত ছিল এ বিষয়ে জাতীয়ভাবে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপির চেয়ারপারসন এই প্রস্তাব দিয়েছেন।
তবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলছেন, খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে সরকার বা দলে কোনো ভাবনা নেই। তা ছাড়া খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে আগ্রহ না দেখানোর কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই প্রস্তাব দিয়ে খালেদা জিয়া কম অর্জন করতে চাইছে তা বোঝার চেষ্টা করছে দলটি। তবে দলের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, সংবিধান নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে। এটি আওয়ামী লীগের কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী এবং তাঁর ক্ষমতার মধ্যে যা আছে তাই করবেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রস্তাব দেওয়ার সমালোচনা করে হানিফ বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার ওনার নেই। কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ‘মাগুরা ও ফালু মার্কা’ নির্বাচন করেছেন। আজ্ঞাবহ আজিজ কমিশন দিয়ে ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিলেন। আর এখন এসব প্রস্তাব দিচ্ছেন।
সরকারের শরিক ১৪ দলের নেতারাও খালেদার প্রস্তাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। শরিক দলের একাধিক নেতা বলেন, এই বিষয়ে জোটের প্রধান শেখ হাসিনার মনোভাব এখনো তাঁরা স্পষ্ট জানেন না। তবে জোটের প্রধান এ বিষয়ে নতুন কোনো কৌশল বা অবস্থান নিলে, তাতে তাঁরা সমর্থন করবেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়া যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, তা দুই বছর আলোচনা করেও শেষ করা যাবে না। তিনি নিজেই বলেছেন, যত দিন ঐকমত্য হবে না, তত দিন আলোচনা চলবে। এই প্রস্তাব ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। আর সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব তারাই দিতে পারে, যারা জোর করে ক্ষমতা দখলে অভ্যস্ত।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সভা থেকে গতকাল খালেদা জিয়ার প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরে পলিটব্যুরোর এক বিবৃতিতে বলা হয়, খালেদা জিয়ার ১৩ দফা আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কৌশলপত্র। গত জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি যে কর্মকাণ্ড করেছে তারই পুনরাবৃত্তি করতে চাইছেন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাবের আড়ালে জামায়াতে ইসলামীকে বগলের তলায় রাখার কৌশল ন্যক্কারজনক। আর নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী নিয়োগের প্রস্তাব অনভিপ্রেত।
তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের একাংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার ঐকমত্যের প্রস্তাবটি সুনির্দিষ্ট নয়। পৃথিবীর কোথাও সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য হয় না। দেশে ১৯৯০ সালে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। এ জন্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে যেতে হয়েছে। ২০০৬ সালেও ঐকমত্য হয়নি। আমরা তো অনির্দিষ্ট সময় ধরে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি না।’
বিএনপির প্রস্তাব বিষয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়ার প্রস্তাব ইতিবাচক। কারণ সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ‘মানি না, মানব না’ বলে আন্দোলনের যে সংস্কৃতি রয়েছে, তা না করে আগেভাগে মতামত দিয়েছে বিএনপি। এই প্রস্তাব শতভাগ গ্রহণ করতে হবে—এমনটি নয়। আবার একেবারেই বাতিল করে দেওয়া ঠিক নয়।
জি এম কাদের বলেন, ‘সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। কিন্তু এর জন্য কোনো আইন বা গাইডলাইন নেই। ফলে খেয়াল-খুশিমতো কমিশন গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে যে প্রস্তাব এসেছে, সেটা গাইডলাইন তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও এমন কোনো প্রস্তাব দেওয়া যায় কি না, সেই চিন্তাভাবনা চলছে।’
জি এম কাদের আরও বলেন, যেকোনো নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের মতামত দেওয়ার অধিকার আছে। নাগরিক সমাজও এই বিষয়ে প্রস্তাব দিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ যা বলেছে সেটি রাজনৈতিক ভাষ্য। বিএনপি-আওয়ামী লীগ শুধু নয়, প্রায় সোয়া নয় কোটি ভোটার, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, দাতা সংস্থাসহ সবাই নির্বাচন কমিশনের অংশীজন। দুটি বা চারটি দল কী বলল তার চেয়ে বড় হলো ভোটারদের আশ্বস্ত করা।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিছু সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সর্বদলীয়-সমর্থিত না হলে, অংশীজনদের নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা না থাকলে কমিশনের পক্ষে কাজ করা খুব কঠিন।