নেতাদের ঘরে ঘরে ১০ টাকার চাল কার্ড বাগিয়েছেন নানা কৌশলে বন্ধ হচ্ছে না লুটপাট

0
731
Print Friendly, PDF & Email

গরিববান্ধব ১০ টাকা কেজির চাল এখন নেতাদের ঘরে ঘরে মিলছে। নানা কৌশলে চালের কার্ড হাতিয়ে তাদের অনেকেই এই লুটপাটে মেতেছেন। অভিযোগের পর অভিযোগ ওঠার পরও বন্ধ হচ্ছে না লুটের এ মচ্ছব।

৩৫ বিঘা জমির মালিকও হতদরিদ্র : চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায় হতদরিদ্রদের ১০টাকা কেজির চাল নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা। নাচোল উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দেয়া তালিকায় প্রায় ৫ হাজার পরিবারের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কার্ড বিতরণ হয়েছে প্রভাবশালী ও দলীয় নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের নামে। ৫ বিঘা জমির মালিক থেকে শুরু করে ৩০ বিঘা জমির মালিকের নামেও বিতরণ করা হয়েছে এই কার্ড। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নাচোল উপজেলার সদর ইউনিয়নের দুলাহার গ্রামের আলহাজ হাফেজ উদ্দিনের ছেলে রাজু আহম্মেদ ৩৫ বিঘা জমির মালিক হলেও তাকে দেয়া হয়েছে হতদরিদ্রের কার্ড। একই গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মৃত জানবক্সের ছেলে নুর-নবীর নামেও দেওয়া হয়েছে কার্ড। এলাকাবাসী জানান, নুরনবী ১৫-২০ বিঘা জমির মালিক এবং সিঙ্গাপুরে তার ছেলে চাকরি করে। একই অভিযোগ মৃত অহির বক্সের ছেলে কেরামত ও কিয়ামতের বিরুদ্ধেও। তারা উভয়ে ৩০ বিঘা করে জমির মালিক। এছাড়া ওই গ্রামের মৃত কাঙ্গালু মণ্ডলের ছেলে আবদুর রহমান ২০ বিঘা জমির মালিক হলেও তিনি হতদরিদ্রদের কার্ড নিয়েছেন। অন্যদিকে নেজামপুর ইউনিয়নের গোসাইপুর, টিকইল, কাজলকেশর গ্রামেও বিত্তবানদের দেয়া হয়েছে ১০টাকা কেজির চালের কার্ড। যাদেও মধ্যে স্কুল শিক্ষক আবদুল হাই সুইট, গোসাইপুর গ্রামের ১৩ বিঘা জমির মালিক নজরুল ইসলামের ছেলে একরামুল হক, ৮বিঘা জমির মালিক মালা বক্সের ছেলে মনিরুল, ৭ বিঘা জমির মালিক সাফিউলের স্ত্রী পিয়ারা খাতুনসহ অনেকে রয়েছেন। এসব বিষয়ে সংসদ সদস্য মুহা. গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস জানিয়েছেন, অভিযোগের তদন্ত করে গোমস্তাপুর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খাদ্য কর্মকর্তা প্রত্যাহার : নাটোর প্রতিনিধি জানান, হতদরিদ্রদের জন্য দেয়া সরকারের ১০ টাকা কেজির চাল উত্তোলনে ব্যাপক অনিময়ের অভিযোগে সদরের ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা (ওসি, এলএসডি) মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে প্রত্যাহার করে দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। দেশে চালের বাজার স্থিতিশীল রেখে সহায় সম্বলহীন হতদরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে কার্ডের মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির জন্য খাদ্য গুদাম থেকে চাল ওঠাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ডিলারদের বিভিন্ন অঙ্কের উেকাচের টাকা গুনতে হচ্ছে— এমন অভিযোগে তাকে গত মঙ্গলবার বিকালে প্রত্যাহার করা হয়। জানা গেছে, এ ব্যাপারে পাবনার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুুল কাদেরকে প্রধান ও বগুড়ার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ওমর ফারুককে সদস্য করে দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাটোরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনিরুল ইসলাম জানান, গঠিত তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে তাদের কাজ শুরু করেছেন। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্রে জানা গেছে, হতদরিদ্রের জন্য ১০ টাকা কেজির চাল নাটোরের সাত উপজেলার ১৪৬ জন ডিলারের মাধ্যমে ৬০০ টন বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের ছাতনী দিয়ার পয়েন্টের ডিলার কুতুব উদ্দিন জানান, তিনি ১০ টাকা কেজির বরাদ্দকৃত চালের ডিও লেটার (চাল উত্তোলনের ছাড়পত্র আদেশ) নিতে গেলে টনপ্রতি তার কাছে ২০০ টাকা করে মোট দুই হাজার টাকা দাবি করা হয়। পরে অনুরোধ করে তিনি উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা জগদীশ চন্দ্রকে ১২০০ টাকা দিয়ে ছাড়পত্রটি গ্রহণ করেন। এরপরে খাদ্য গুদামে চাল উত্তোলন করতে গেলে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, এলএসডি) মোহাম্মদ নুরুজ্জামান দাবি করেন আরও দুই হাজার টাকা। সেখানে দিতে হয় এক হাজার টাকা। এ ছাড়াও খাদ্য গুদামের শ্রমিকদের দিতে হয় টনপ্রতি ১০০ টাকা করে। এতে হতদরিদ্রদের জন্য বিতরণের চাল উত্তোলনের সময় গুনতে হচ্ছে বিভিন্ন অঙ্কের উেকাচের টাকা। কুতুব উদ্দিন অভিযোগ করেন, এখন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক টেলিফোন করে সব ডিলারকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এসে অথবা তাদের বাড়ি গিয়ে টাকা নেওয়া হচ্ছে না মর্মে লিখিত নিচ্ছেন। একইভাবে কাফুরিয়ার জালাবাদ পয়েন্টের ডিলার রাকিবুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, অভিযোগ করেই তিনি বিপাকে পড়েছেন। নানাভাবে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য বিভাগের চাল সরবরাহকারী অন্য আরও একজন ডিলার জানান, নাটোরের খাদ্য বিভাগ একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেখানে টাকা না দিলে কোনো কাজই হয় না। ভাল ধান-চাল সরবরাহের সময়েও তারা নানান দোষ-ত্রুটি বের করলে টাকা দিয়ে সুরাহা করতে হয়। খাদ্যশস্য উত্তোলনের জন্য ডিও তোলা থেকে শুরু করে চাল, গম অথবা ধান গোডাউনে ঢোকানো বা বের করার প্রতিটি পর্বেই উেকাচের টাকা গুনতে হয়। তারা স্থায়ীভাবে ধান-চাল সরবরাহের ব্যবসা করার কারণে হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না বলেও জানান। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জগদীশ চন্দ্র বলেন, উেকাচ গ্রহণের অভিযোগ সঠিক নয়, মনগড়া কথা যে কেউ বলতেই পারেন। খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান জানান, তিনিও কোনো টাকা-পয়সা নেন না। তবে গুদামের শ্রমিকরা নিয়ে থাকতে পারেন। শ্রমিক সর্দার বাবু জানান, তারা ডিলারদের কাছ থেকে চেয়েই বকশিশ নেন।

অনিয়ম খতিয়ে দেখছে দুদক : চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ১০ টাকা দরে চাল বিক্রির অনিয়ম খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিকভাবে সংস্থাটি চাল বিক্রির বিষয়টি পর্যবেক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. আবু সাইদ বলেন, ‘আমরা আপাতত চাল বিক্রিতে অনিয়ম হচ্ছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করছি। পর্যবেক্ষণে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ধরা পড়লে আইনি পদক্ষেপ নেব।’ জানা গেছে, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রিতে নিয়ম না মানার বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে দুদুকের পর্যবেক্ষক দল ছাড়াও রাউজান, হাটহাজারী ও বোয়ালখালী উপজেলায় দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক নিজে গিয়ে এই কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেছেন। আনোয়ারা এবং বাঁশখালী উপজেলায় দুজন সহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে গঠিত দুটি পৃথক টিম পাঠানো হয়েছে। কক্সবাজারে উপ-পরিচালকের নেতৃত্বেও একটি টিম পাঠানো হয়েছে।

শেয়ার করুন