সম্মেলনের পাঁচ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন (কয়েকটি পদ বাকি থাকা সত্ত্বেও) দলের নেতৃত্বের গতিশীলতারই প্রমাণ। এবারের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ কমিটির রদবদলটিও চোখে পড়ার মতো। সাধারণ সম্পাদক পদে এসেছেন ওবায়দুল কাদের, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জায়গা পেয়েছেন সভাপতিমণ্ডলীতে।
এত দিন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর পক্ষ থেকে বলা হতো, দলে শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফের বিকল্প নেই। এখন তাঁরা সৈয়দ আশরাফের বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন। শেখ হাসিনাও দলে বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে বলেছেন। সজীব ওয়াজেদ জয়কে লক্ষ করে নতুন সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ নেতা।’ দেখা যাক, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে দলে আর কী কী পরিবর্তন আসে।
আওয়ামী লীগের পুনর্গঠিত কমিটি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ইতি-নেতি দুই ধরনের আলোচনা লক্ষ করা যাচ্ছে। ইতিবাচক হলো কমিটিতে নবীনের প্রাধান্য ঘটেছে; নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীর অংশীদারত্ব বেড়েছে ৭ শতাংশ, যেখানে বিএনপির কমিটিতে মাত্র ১ শতাংশ। সব মিলিয়ে এখন আওয়ামী লীগের কমিটিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব ২০ শতাংশের মতো। নবীনদের অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ। এটি আশাব্যাঞ্জক।
তবে আওয়ামী লীগের এবারের কমিটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো সম্পাদকমণ্ডলীতে সাধারণ সম্পাদক ছাড়া কোনো মন্ত্রীকে না রাখা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার ও দলকে আলাদা করার লক্ষ্যেই এটা করা হয়েছে। সভাপতিমণ্ডলীতে অবশ্য বেশ কয়েকজন মন্ত্রী আছেন। দলের নতুন সাধারণ সম্পাদক এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, মন্ত্রীরা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত। ফলে তাঁদের পক্ষে দলের সাংগঠনিক কাজে বেশি সময় দেওয়া কঠিন। তবে তিনি তাঁর নিজের মন্ত্রিত্ব ও সাধারণ সম্পাদক উভয় পদে থাকার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, তিনিও দলীয় সভানেত্রীর মতো সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে দিনের কাজ শুরু করেন এবং দুই দায়িত্ব পালন মোটেই কঠিন হবে না। এর মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক কি এ-ই বোঝাতে চেয়েছেন যে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী দেরিতে ওঠেন এবং সে কারণে তাঁদের পক্ষে মন্ত্রী ও দলের কোনো সম্পাদক পদের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়?
এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি যে পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে এ এইচ এম কামারুজ্জামানও মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সভাপতি হয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি দল ও সরকারকে কতটা আলাদা করতে পারবে? দল ও সরকার আলাদা করার অর্থ কেবল ব্যক্তির পদ বদল নয়; দলের চরিত্রও বদল। সরকার কীভাবে পরিচালিত হবে, তার নীতি ও কর্মসূচি কী হবে, সেসব ঠিক করে দেবে দল। আর বাস্তবায়ন করবে সরকার।
সরকার ও দলের কাঠামো কখনোই একাকার হয়ে যেতে পারে না। সরকারের নীতি ও কর্মসূচি দল ঠিক করে দিলেও সেটি বাস্তবায়নের আলাদা কাঠামো, সংস্থা ও জনবল আছে। সেখানে দলের কোনো হস্তক্ষেপ বা খবরদারি কাম্য নয়। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি যে সরকারের, তথা প্রশাসনের বিভিন্ন কার্যক্রমে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা অযাচিত হস্তক্ষেপ
করে থাকেন। এবং সেই হস্তক্ষেপ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থেকে শুরু করে কাবিখা-টাবিখার টাকা বরাদ্দ পর্যন্ত।
অতি সম্প্রতি সরকার ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার যে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নিয়েছে, সেটি নিয়েও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নয়ছয় করছেন বলে অভিযোগ এসেছে। অনেক জায়গায় প্রকৃত গরিব ও দুস্থ ব্যক্তিদের বঞ্চিত করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা চাল আত্মসাৎ করছেন। বিষয়টি জাতীয় সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনেও আলোচনা হয়েছে। এভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের হস্তক্ষেপের কারণে সরকারের একটি মহৎ কর্মসূচিও ভেস্তে যাওয়ার পরও প্রতিকারের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
স্থানীয় প্রশাসনে দলীয় হস্তক্ষেপের বিষয়ে খোদ জেলা প্রশাসকেরাও অভিযোগ করে থাকেন বার্ষিক সম্মেলনে। প্রতিবছর জেলা প্রশাসকদের যে সম্মেলন হয়ে থাকে, তাতে প্রায় সবার অভিযোগ থাকে যে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের খবরদারির কারণে প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। অনেক সরকারি কর্মকর্তা দলীয় নেতা-কর্মীদের অন্যায় আবদার মেনে নিলেও কেউ কেউ বেঁকে বসেন। ফলে উন্নয়নকাজেও বাধা আসে আসে। তিন মাসের প্রকল্প তিন বছরেও শেষ হয় না।
স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে পড়ে পুলিশ প্রশাসন। তারা দলমত-নির্বিশেষে সব অপরাধীকে পাকড়াও করতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বাদ সাধেন। নিজ দলের লোকদের দেখিয়ে বলেন, ‘এরা আমার লোক। এদের ধরা যাবে না।’ সে ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসন অসহায় বোধ করে। অনেকের পক্ষেই স্থানীয় নেতাদের চাপ উপেক্ষা করে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া এবং চালিত করা সম্ভব হয় না।
এখানেই সরকার ও দল আলাদা করার প্রশ্নটি আসে। সরকারের যেকোনো সংস্থা আইন অনুযায়ী কাজ করবে। দলের নেতা-কর্মীরা কোনোভাবেই সরকার বা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন না। আবার প্রশাসনও গৃহীত নীতি-কর্মসূচির বাইরে যাবে না। এটাই হলো সরকার ও দল আলাদা করার উত্তম পথ।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের সময় দল ও সরকারকে আলাদা করতে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। নতুন সাধারণ সম্পাদক পারবেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়