গুলিস্তানে ছাত্রলীগের দুই নেতা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করলেও পুলিশ তাদের ব্যাপারে তদন্তে নামেনি। এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি। পুলিশ অস্ত্রধারীদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, অস্ত্রের লাইসেন্স আছে কি-না সে ব্যাপারেও জানতে চাওয়া হয়নি তাদের কাছে। তবে পুলিশ বলছে, অস্ত্রধারীদের নামে অস্ত্রের লাইসেন্স আছে কি-না, সে ব্যাপারে আজ রোববার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছেন, অস্ত্রধারীদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরও পুলিশ তাদের ডেকে অস্ত্রের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ না করার বিষয়টি রহস্যজনক। এদিকে গুলিস্তানের পাতাল মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। গুলি ও ভাংচুর করা হলেও আতঙ্কে তারা অস্ত্রধারী ও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অস্ত্রধারীদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নীরব রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে তারা গড়িমসি করছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পাচ্ছেন না। তাদের তো সেখানে ব্যবসা করে খেতে হবে। অস্ত্রধারী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাবি্বর হোসেন ও ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমানসহ হামলাকারীদের নিয়ে তারা বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান না। গত বৃহস্পতিবার পাতাল মার্কেটে হকিস্টিক ও চাপাতি নিয়ে ২৫-৩০ যুবক হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও ব্যবসায়ীদের মারধর করার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে। ঘটনার তিন দিনেও সেই হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু স্কয়ার পাতাল সড়ক মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালান। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনসহ ব্যবসায়ীরা অভিযানে বাধা দেন। এ সময় আনোয়ারকে আটক করে নগর ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে আটকের পর বেলা ১টার দিকে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী ও হকাররা নগর ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। দুপুর ২টার দিকে সিটি করপোরেশনের কর্মচারী ও নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী-হকারদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। কর্মচারী ও নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে যোগ দেয় একদল যুবক। ওই যুবকদের কাতারে ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাবি্বর হোসেন ও ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান। তারাসহ অন্তত ১০ যুবক অস্ত্র বের করে ব্যবসায়ী-হাকারদের ধাওয়া করে। পাল্টা ধাওয়া করলে সাবি্বর ও আশিকুরসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও হকারদের আতঙ্কিত করতে ফাঁকা গুলি করে। একপর্যায়ে নগর ভবন থেকে তাদের ধাওয়া করে গুলিস্তানে চলে আসে আগ্নেয়াস্ত্র, হকিস্টিক ও চাপাতিধারী যুবকরা।
বেলা পৌনে ৩টার দিকে ২৫-৩০ যুবক হকিস্টিক ও চাপাতি নিয়ে পাতাল মার্কেটে হামলা চালায়। সেখানে ব্যবসায়ীদের মারধর ও দোকান ভাংচুর করে। একটি ভিডিও ফুটেজে এ দৃশ্য ধরা পড়েছে। ফুটেজে দেখা যায়, দুপুর ২টা ৪৬ মিনিটে ওপর থেকে হামলাকারীরা পাতাল মার্কেটের ভেতরে একটি লাল রঙের বক্স ছুড়ে ফেলে। হামলাকারীদের আসতে দেখে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে পালাতে থাকেন। এর পরই প্রথমে একসঙ্গে চার যুবক হকিস্টিক নিয়ে ঢোকে। তাদের পেছনে আরও দুই যুবকের হাতে ছিল হকিস্টিক। সিঁড়ি দিয়ে নেমে তারা মার্কেটের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর পরই চাপাতি ও হকিস্টিক নিয়ে ঢোকে আরও অন্তত ২০ যুবক। তাদের কারও হাতে চাপাতি, কারও হাতে বড় হকিস্টিক, কারও হাতে বাঁশ ছিল। তারা সেখানে ভাংচুর চালায়। সহিদ নামে এক ব্যবসায়ীকে মারধর করতেও দেখা যায় ওই ফুটেজে।
মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, হামলার ঘটনায় তারা কোনো মামলা করবেন না। এ ব্যাপারে তাদের কোনো অভিযোগও নেই। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে গতকাল গুলিস্তানে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাত দখল করে ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলে বসেছেন। তবে তাদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের ছাপ ছিল। একটি সূত্র জানায়, সাবি্বর হোসেন প্রায় প্রতিদিনই নেতাকর্মী নিয়ে নগর ভবনে যান। তিনি নিজেকে সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দেন। আশিকুর সাবি্বরের ঘনিষ্ঠ। তারা একে অপরের ‘মামা-ভাগ্নে’ হিসেবেই পরিচিত। সূত্র জানিয়েছে, সে দিন আরও কয়েকযুবক অস্ত্র বের করেছিল। তবে গনমাধ্যমে সাবি্বর ও আশিকুরের হাতে অস্ত্রের ছবি প্রকাশিত হয়। সাবি্বরের বাসা পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে আর আশিকুরের বাসা ওয়ারীর র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। সিদ্দিক বাজারে কয়েকটি মার্কেট থেকে সাবি্বরের নামে চাঁদা উঠে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তার একটি বাহিনী রয়েছে। মোটরসাইকেল নিয়ে তারা মহড়া দিয়ে বেড়ায় এলাকাজুড়ে। সূত্র জানিয়েছে, সাবি্বর ও আশিকুরের আগ্নেয়াস্ত্র অবৈধ।
দক্ষিন সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সমকালকে জানান, কেউ আইনের ঊধর্ে্ব নয়। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। ছাত্রলীগ নেতা সাবি্বর চেনাজানা।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তারেক বিন রশিদ সমকালকে বলেন, অস্ত্র হাতে যাদের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে, তাদের নামে অস্ত্রের লাইসেন্স আছে কি-না সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
পল্টন থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, অস্ত্র বা হামলার অভিযোগ নিয়ে থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। তবে অস্ত্রের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে অস্ত্রধারী দুই ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে গতকালও একাধিক দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সাবি্বর ও আশিকুরের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি বসে এ নিয়ে আলোচনা করার সময় পাননি তারা। খুব শিগগির বৈঠক হবে এবং সাবি্বর ও আশিকুর দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।