স্বপ্নের বিভ্রান্তিতে বিএনপিকেউ স্বপ্ন দেখেন, কেউ দেখান। অনুভবে থাকেন অন্যরা। অন্যদিকে ক্ষমতার স্বপ্ন ক্লান্তিতে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা এখন রাজনীতির খেই হারিয়ে ফেলছেন। দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে এমনটাই জানা গেছে। তারা বলেন, এই দলে এখন এক শ্রেণীর নেতা রয়েছেন যারা প্রতিনিয়ত বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসছেন। এই ঈদের পরের ঈদ, শীতের পর শীত কিংবা এই বছরের পর সামনের বছর। আর বিপরীতে দলের হাইকমান্ডও তাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাসে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। তাই তাদের স্বাভাবিক রাজনীতিও এখন স্বপ্নেভরা হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের। তবে এই দুই অংশে বিএনপির সর্বোচ্চ হাইকমান্ড এবং হাতেগোনা কয়েক নেতা রয়েছেন। আর অন্যরা রয়েছেন হতাশার মধ্যেই।
বিএনপির কয়েক সিনিয়র নেতা জানান, এই দলে এখন একটি চিহ্নিত সিন্ডিকেট তৎপর। দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত, সাংগঠনিক কিংবা রাজনৈতিক তাদের পরামর্শ ছাড়া অসম্ভব। তারাই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে প্রতিনিয়ত ক্ষমতায় আনার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, দেশের জনগণ থেকে দূরে সরে গেছে। তাই সরকারকে সরানোর জন্য বিএনপির কিছু করা দরকার নেই। শুধু চুপ করে থাকলেই হবে। যে কোনো সময়ে সরকার বাধ্য হয়ে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে বলে পরামর্শ দিয়ে চলছেন ওই সিন্ডিকেট। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে একটি ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের প্রতি সম্পর্ক রাখলেই বিএনপির লাভ। প্রতিবেশী ওই রাষ্ট্র এখন বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার পক্ষে বলেও দলের মধ্যে প্রচারণা চালু করেছেন তারা। এ রকম বিভ্রান্তির কারণে দলের সর্বোচ্চ হাইকমান্ড স্বাভাবিক রাজনীতি থেকেও নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। দলকে আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেলে সাজানোর সব প্রক্রিয়া থেকেই দূরে সরে রয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য কলা-কৌশল থেকেও বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে এই দলটির কোনো সংযোগ সেতু এখনো তৈরি হয়নি। এমনটাই জানিয়েছেন ওই সিনিয়র নেতারা।
তারা জানান, এর আগে ভারতের বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসা উপলক্ষে বিএনপি এক ধরনের ঢেঁকুর গিলতে শুরু করেছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্যের কোঠায়। আর এখন অপেক্ষায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের জন্য। বহুমুখী রাজনীতি না থাকার কারণে বিএনপির দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা চীনও এখন আর নেই। মূল কথা- বহির্বিশ্বে এক ধরনের বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে এই দলটি। এসব বিষয়ে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দলটির হাইকমান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ঘরে বসে বাণী দিয়ে কিংবা আমেরিকা ও ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না। বিএনপি চেয়ারপার্সন মানসিক অবসাদে ভুগছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়েই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাস্তায় না নেমে কেউ গণতন্ত্র আনতে পারেনি।
বিএনপির কূটনৈতিক শাখায় কাজ করেন এমন এক নেতা বলেন, দলের একটি চিহ্নিত গ্রুপ এতদিন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থান থেকে অনেকটা অন্ধকারে রেখেছিলেন। তারা তাকে এটা বুঝিয়েছিলেন, পার্শ্ববর্তী ওই রাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই শুধু তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। কিন্তু গ্লোবাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। একটি দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে রাজনীতি করলে আমাদের অর্জন বিসর্জন হয়ে যাবে। এসব বিষয়সহ বহির্বিশ্বের রাজনীতি এবং আমদের কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।
এ দিকে বিএনপির সিনিয়র পর্যায়ের কয়েক নেতা জানান, বর্তমানে বিএনপি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছেন ওই সিন্ডিকেটের কতিপয় নেতা। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আর এর পেছনে শক্তি জোগাতে সাহায্য করছেন মির্জা আব্বাসদের মতো নেতারা। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়ে পড়েছেন অনেক মধ্যম সারির নেতা। তবে তাও হাতেগোনা কয়েকজন, যারা ইতিমধ্যে নিজেদের ভাগ ও ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন। আর বিপরীত রয়েছেন দলের অন্যান্য সব পর্যায়ের নেতারা, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী। সংখ্যাধিক্যে দ্বিতীয় অংশটি শক্তিশালী হলেও ক্ষমতার দিকে প্রথম অংশটাই ছড়ি ঘোরাচ্ছেন সব কর্মকাণ্ডে। তাদের এই ক্ষমতার দোর্দণ্ড প্রতাপ লক্ষ্য করা গেছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সব কার্যক্রমে। এসব জায়গায় বজায় রেখেছেন তাদের একক আধিপত্য। আর দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে দলের ত্যাগী, যোগ্য আর বাস্তববাদীদের। কিন্তু বিএনপির হাই কমান্ডকে দেখানো সিন্ডিকেটের স্বপ্ন যখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে বা হবে তখন সময়টাও অনেক পার হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ওইসব নেতা।
দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেছেন, ওনারা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে বুঝিয়েছেন- জনগণ ক্ষমতাসীন দলের ওপর রুষ্ট হয়ে আছে। বিএনপিকে কিছু করতে হবে না। জনগণই ক্ষুব্ধ হয়ে রাজপথে নেমে আসবে। আমরা এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলে সরকারের রোষানলে পড়ে নেতাকর্মীদের ক্ষয়ক্ষতি হবে। এ ছাড়া সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য বিএনপির ওপর দোষারোপ করে নিজেদের কৃতকর্ম আড়াল করার চেষ্টা করবে। এতে হিতে বিপরীত হবে বলেও তারা পরামর্শ দিচ্ছেন। তাই নীরবতা পালনই শ্রেয় আমাদের জন্য।
দলের ওপর ওই গ্রুপটির পুরোপুরি আধিপত্য আনার সব আয়োজনই তারা করছেন। এখন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন থেকে শুরু করে সারাদেশের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় নিজেদের মতো করেই শুরু করেছেন। সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী যুবদলের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার জন্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ আরো কয়েকজন বিএনপি নেতা চেয়ারপার্সনের কাছে যান বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে গ্রুপেরই আস্থাভাজন নেতা মোহাম্মদ শাহজাহানের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সারাদেশের কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। তিনি ঢাকাতে বসেই জেলার কমিটি গঠন কাজ করে যাচ্ছেন।
এই প্রক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পিরোজপুর জেলা বিএনপির এক নেতা মানবকণ্ঠকে বলেন, শাহজাহান একটি দোকান খুলে বসেছেন। তিনি যাকে ইচ্ছা জেলা থেকে ডেকে পাঠান।