রোগমুক্তির আশায় কলকাতায় বিক্রি বাড়ছে গো-মূত্রের

0
149
Print Friendly, PDF & Email

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর৷ বিজ্ঞানের যুক্তি-বুদ্ধি যাই বলুক, জটিল নাগরিক জীবনে শত সমস্যায় দিশাহীন মানুষ ক্রমেই শরণ নিচ্ছে অন্ধ বিশ্বাসের৷ চিকিত্সার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই৷ রোগমুক্তির আশায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর কলকাতার বাজারেও বিক্রি বাড়ছে গো-মূত্রের। এতে করে ব্যবসাও জমে উঠেছে। তাই গো-বলয় ছাড়িয়ে এখন কলকাতার শো-রুমে উঁকি মারছে গো-মূত্রের ঝকঝকে বোতল৷ অনলাইনেও বিক্রি বাড়ছে৷ এর ফলে রোগমুক্তিতে গো-মূত্রের উপর কতটা নির্ভর করা যায়, তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ চিকিত্সকদের একাংশের বক্তব্য, বিজ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে বেশ কিছু সংস্থা৷ তলে তলে রাজনীতিও দেখছেন অনেকে৷ রাজ্যের আয়ুর্বেদ চিকিত্সক এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রেতাদের দাবি, গো-মূত্র পান করে কম করে ১০০টি রোগ ভালো হয়৷ ক্যান্সারের চিকিত্সাতেও নাকি ভালো ফল পাওয়া গেছে। সে জন্যই সারা ভারতের সঙ্গে কলকাতাতেও গো-মূত্রের চাহিদা বাড়ছে৷ তবে অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সকরা বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে, গো-মূত্রে রোগ উপশমের কোন প্রশ্নই উঠে না৷ এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই৷ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়েই বেআইনি কারবারের ফাঁদ পাতা হয়েছে৷ এতে রোগ নিরাময়ের বদলে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ দেশটির ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজির অধ্যাপক-চিকিত্সক স্বপন জানা বলেন, ‘গো-মূত্রে রোগ নিরাময়ের নামে লোককে ঠকানো হচ্ছে৷ অতীতে যখন চিকিত্সা বিজ্ঞান এতটা উন্নত হয়নি, তখন আজকের মতো এত আধুনিক ওষুধ ছিল না৷ সেই সময় মানুষ এসব ব্যবহার করত৷ রোগ নিরাময়ের জন্য শুধু গো-মূত্রই নয়, মানুষের মলও কাজে লাগানো হত৷ ঘা সারানোর জন্য তিব্বতীয়রা দলাই লামার মল লাগাতেন৷ গো-মূত্রের ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে৷’ তার দাবি, গো-মূত্রে এমন কিছু নেই, যা দিয়ে রোগ নিরাময় হতে পারে। মানুষের প্রস্রাবে যা আছে, গোরুর মূত্রেও তাই রয়েছে৷ যেমন, আ্যামোনিয়া, ইউরিক অ্যাসিড, কমন সল্ট এবং ইউরিয়া৷ রোগ নিরাময়ে এক সময় মানুষ নিজের প্রস্রাব পান করতো। প্রকৃতি বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সে সব এখন অচল হয়ে গেছে। দেখা যায়, যে রোগ সারে না, সেই সব রোগেই এক রকম ডেসপারেশন থেকে এ সব ব্যবহার হচ্ছে৷ ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিক্স অ্যাক্ট-এর (রুল ১৯৪৫) শিডিউল জে-তে কয়েকটি দূরারোগ্য ব্যাধির উল্লেখ রয়েছে৷ তালিকায় রয়েছে ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মৃগি, হাঁপানি, অ্যাজমা, শ্বেতি, চুলপড়া, যৌবন রাখা, লিঙ্গ বড় করা ইত্যাদি৷ এ সবের কোন ওষুধ নেই৷ এই সব রোগের চিকিত্সার নামেই লোকের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে গোরুর মূত্র, বিভিন্ন গাছের ছাল, ফল-মূল ইত্যাদির কারবার ফেঁদে বসে অনেকে৷ ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট আয়ুর্বেদ এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক প্রদ্যোত্বিকাশ কর মহাপাত্রের বক্তব্য, ‘আয়ুর্বেদে গো-মূত্রের ঔষধি গুণ প্রমাণিত৷ তা বলে এটি আদৌ সর্বরোগহরা নয়৷ শুধু গো-মূত্র সেবন করলেই প্রচুর উপকার হবে, এমন ভাবার কারণ নেই৷ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাবডমিনাল টিউমারসহ বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে অন্য ওষুধের সঙ্গে গো-মূত্রের মিশ্রন ভালো কাজ করে৷’ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কলুটোলার একটি আয়ুর্বেদিক চিকিত্সালয়ের চিকিত্সক অজিত কুমার আরও এক ধাপ এগিয়ে দাবি করেছেন, গো-মূত্র সেবনে কিডনি, লিভার, ফুসফুসের রোগ সেরে যায়৷ ক্যান্সার আক্রান্তরাও ভালো ফল পাচ্ছেন৷ তার কথায়, ‘মানুষ উপকার না পেলে আর টাকা খরচ করে গো-মূত্র কেন কিনবেন?’ রোগীর পথ্য হিসাবে ভারতে গো-মূত্র খাওয়ার রেওয়াজ অবশ্য বহু দিনের৷ ঋকবেদে গো-মূত্র ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে৷ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী, গোরুর মূত্র কম করে ১০০টি রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে৷ তার মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপ, অ্যাজমা, একজিমা, হার্টঅ্যাটাক, পাইলস, প্রস্ট্রেটের সমস্যা, আর্থাইটিস, মাইগ্রেন, থাইরয়েড, আলসার, গ্যাস-অম্বল, এমনকি ক্যান্সারও৷ শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রাচীন ঋষিরা অনেকে গো-মূত্র সেবন করতেন৷ উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, গুজরাটের মতো কিছু রাজ্যে গ্রামাঞ্চলে গো-মূত্র খাওয়ার চল রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তেমনটা অতীতে শোনা যায়নি৷ তবে গত এক বছরে গো-মূত্রের ব্যবসায় বাকি রাজ্যগুলোকে রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছে বাংলা৷ কলকাতার টালায় বিটি রোডের ধারে একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকানের মালিক অনুভব দত্ত বলেন, ‘বাজারে গো-মূত্রের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে৷ মাসে প্রায় ৩০০টির বেশি ফাইল বিক্রি হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু চাহিদার তুলনায় জোগান খুব কম৷ ফলে চাইলেই সবাইকে দিতে পারছি না৷’ পার্ক স্ট্রিটের একটি খ্যাতনামা আয়ুর্বেদিক বিপণির ম্যানেজার রূপা সরকারও জানিয়েছেন, গো-মূত্রের চাহিদা ক্রমে বাড়ছে৷ সে তুলনায় জোগান কম৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য এর পিছনে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটির এবং তাদের শাখা-প্রশাখার কারসাজিও দেখছেন৷ যে রাজনীতি পাল্টা মতাদর্শগত লড়াইয়ের অনুপস্থিতিতে একটু একটু করে জীবন এবং যাপনের সব ক্ষেত্রেই আগ্রাসন চালাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষকদের৷ ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয়েরও আশঙ্কা করছেন তারা৷

শেয়ার করুন