আগামী বাজেট নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আকার বড় নয়, বাজেট হতে হবে বাস্তবসম্মত

0
473
Print Friendly, PDF & Email

বাজেট বড় আকারের করলেই হবে না, তা থেকে সাধারণ মানুষের কাছে সুফল পৌঁছে দিতে হলে বাজেট বাস্তবসম্মত এবং বাস্তবায়নযোগ্য করতে হবে। তা না হলে বড় বাজেট ওই ছাপাতেই থেকে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, সরকারের উচিত কোন কোন খাত আগের বাজেটে সাফল্য এসেছে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া। অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আকার বাড়লেই অর্থনীতির ভিত মজবুত হয় না। বরং এতে আর্থিক খাত আরো দুর্বল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। আমাদের বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতাও বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের আর্থিক খাতকে আরো শক্তিশালী করে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির টার্গেট নিয়ে নতুন বাজেটকে বাস্তবসম্মত করা উচিত। সেই সাথে দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনতে পারলে অর্থনীতির চলমান স্থবিরতা কাটবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা।
নতুন বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ‘কর্মসংস্থান’কেন্দ্রিক হওয়া উচিত মনে করেন তারা। তাদের মতে, বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার এখন বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ-আমেরিকাসহ এশিয়ার দেশগুলো থেকেও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নতুন তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এ অবস্থায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে দেশীয় কর্মসংস্থান তৈরি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
নতুন বাজেটের আকার হবে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই আকার নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, আকার বাড়লেই অর্থনীতির ভিত মজবুত হয় না। বরং এতে আর্থিক খাত আরো দুর্বল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বাজেট হওয়া দরকার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে। তিনি বলেন, বড় বাজেটে বাড়তি ঝামেলার বোঝার চাপ থাকে। বাজেট বাস্তবায়নের চেয়ে খরচ বাড়ানোর বাজে প্রবণতা তৈরি হয়। নতুন বাজেট হওয়া উচিত একেবারেই বিশ্বায়ন ও দেশের সার্বিক আর্থিক খাত বিবেচনায় নিয়ে। তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন করার দক্ষতা আমাদের এখনো ঘাটতি আছে। সেই দক্ষতা না বাড়িয়ে বড় বাজেট করে সেটা কে বাস্তবায়ন করবে?
আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রতি বছরই বাজেটের আকার বড় করা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন তা হয় না। আগামী বাজেট করার আগে সরকারের উচিত কোন কোন খাতে এ পর্যন্ত সাফল্য এসেছে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া। অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বড় বাজেট করে কোনো সাফল্য হয় না। তিনি বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই বাজেট করতে হবে। সম্পদ ও ব্যয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় হতে হবে। ব্যাংকিং খাত থেকে টাকা ধার নিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবে সরকার। কিন্তু এটা করা ঠিক হয় না।
উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, আমরা যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) করি তা আরো বেশি বাস্তবসম্মত হতে হবে। যে পরিমাণ প্রকল্প নেয়া হয় তা বাস্তবায়ন হয় না। সরকারের উচিত ভালো ভালো প্রকল্প নেয়া। এত প্রকল্প না নেয়া। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারব এমন প্রকল্প নেয়া উচিত। এ ছাড়া বড় বড় বা মেগা প্রকল্প সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। তিনি বলেন, সামাজিক খাতে বাজেটের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নেও নজর দিতে হবে। এসব খাতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাতে ব্যয় ঠিক হচ্ছে। দরিদ্র মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সেবা দিতে হলে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বাংলাদেশ-গ্রিস চেম্বারের মহাসচিব ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রায় পুরো সময়জুড়েই দেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থার সঙ্কট ছিল। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোই কিছু অনিয়ম ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে নতুন বিনিয়োগে অনীহার কারণে দেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে অনাকাক্সিত ঘটনা গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নাড়া দিয়ে গেছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিতিশীলতার কারণে বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপের দেশগুলোতে অনেক বাংলাদেশী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছেন। সেসব দেশ থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানোর হুমকি দেয়া হয়েছে। যদিও এই হুমকি তাৎক্ষণিক কার্যকর হবে না, তবে এটা ধরে নিতে হবে বছর কয়েকের মধ্যে এসব বাংলাদেশী ফেরত আসতে হতেও পারে। এ কারণে নতুন বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার ‘অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান’-এর বিষয়টি।
বিশ্ববাজারে তেলের বড় দরপতনে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহেও ভাটা পড়েছে উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান জানান, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসী আয় আসে ৯৭৭ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৫২ ভাগ কম। শতকরা হিসাবে পরিমাণটা যে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তা নয়। তবে সামনের দিনগুলোতে এর নেতিবাচক ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে শঙ্কা বাড়বে। তিনি জানান, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের বড় কোনো উদ্যোগ নেই। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার পরও গত এক বছরে বিদেশী বিনিয়োগে বড় ধরনের সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই বাজেটে বিদেশী বিনিয়োগ আসার জন্য আকর্ষণ সৃষ্টি করতে হবে।

শেয়ার করুন