রান্নাঘরের পাশাপাশি গ্যাস সংকটের ধাক্কা লেগেছে রাজধানীর সিএনজি ফিলিং স্টেশনে। চাপ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকেও গাড়ি পাচ্ছে না প্রয়োজনীয় গ্যাস। ভোগান্তি তাই রাস্তায়ও।
গ্যাস সঙ্কটে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা
মঙ্গলবার এমন চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর বিভিন্ন ফিলিং স্টেশনে।
সকালের দিকে মহাখালীতে কথা হয় আজাদ নামে এক অটোরিকশা চালকের সঙ্গে। অপেক্ষায় ছিলেন তিনি, তবে গ্যাস পাবেন কিনা তা নিয়েও তার সন্দেহ কাটছিল না।
বললেন, কয়েকটি স্টেশন ঘুরে এখানে এসেছেন; দীর্ঘ সারি শেষে কখন গ্যাস মিলবে বা মিলবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ তার মনে। জ্বালানি সংগ্রহ করতে না পারলে খিলগাঁওয়ে নিজের গ্যারেজে কীভাবে ফিরবেন, সেই দুশ্চিন্তাও রয়েছে তার।
গ্যাসের অভাবে গত ১০ দিন ধরে ভোগান্তির শিকার হওয়ার কথা জানান এই চালক।
“গত ১০দিন ধরে সিএনজি নিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। আবার গ্যাস পেলেও তা আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এসব ঝামেলা শেষ করে রাতের জমার টাকা নিয়ে ফিরতে পারছি না। মালিকরা তো আর ছাড় দিচ্ছে না।”
২০০২ সাল থেকে গাড়িতে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে অটোরিকশা ছাড়াও বিভিন্ন গাড়ি এই গ্যাস নির্ভর হয়ে পড়েছে।
সাশ্রয়ী হওয়ায় পেট্রোল ও অকটেনের পরিবর্তে সিএনজি এখন বেশিরভাগ ব্যবহারকারীর প্রথম পছন্দ।
শীত মৌসুম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আবাসিক এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। চলতি মাসের শুরু থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তৈরি সিএনজিতে সংকটের ধাক্কা লাগে, যা ক্রমেই বাড়ছে।
১৪ বছর আগে সিএনজি চালুর পর থেকেই সিএনজি ফিলিং স্টেশনে কাজ করছেন মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় অবস্থিত এবিএন সিএনজি ফিলিং স্টেশনের ব্যবস্থাপক শহীদুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এর আগেও শীতকালে গ্যাসের চাপ কমে যেত। কিন্তু এবার যেভাবে গ্যাসের সরবরাহ শূন্যে নেমে এসেছে তা আগে কখনও দেখা যায়নি।”
শহীদুল জানান, তাদের স্টেশনে ১৬ থেকে ১৭ পিএসআই চাপে গ্যাস এলেও শতভাগ সরবরাহ করা যায়। কমপক্ষে পাঁচ পিএসআই গ্যাস এলে তাদের আটটি লিভারের মধ্যে অন্তত দুটি চালু রাখতে পারেন। কিন্তু এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না।
“গত ১০ দিন ধরে রাত সাড়ে ১১টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ে সামান্য পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে। দিনে মাত্র একঘণ্টা স্টেশন চালু রাখা যাচ্ছে, বাকি সময়টা বন্ধ থাকছে।”
সংকটে লোকসান সবারই
গ্যাস সংকটের কারণে সিএনজি চালিত গণপরিবহনের চালকরা যেমন লোকসানের মুখে পড়ার দাবি করছেন তেমনি ফিলিং স্টেশনগুলো বলছে, পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় তাদের প্রতিষ্ঠানও ক্ষতির মুখে পড়ছে।
ঈসা গার্ডেন সিএনজি স্টেশনের মেইনটেইন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার মো. স্বপন জানান, ২৪ জানুয়ারি সারাদিনে তাদের ইনপুট ও আউটপুট মিটারের মধ্যে ২৩৫ ঘনমিটার গ্যাসের হেরফের হয়েছে।
“অর্থাৎ তিতাসের সরবরাহ লাইন থেকে যে পরিমাণ গ্যাস এসেছে বলে মিটারে উঠছে তা সঙ্কুচিত করে (সিএনজি) বিক্রির পর দেখা গেছে ২৩৫ ঘনমিটার কম। প্রতি কিউবিক মিটার ৩৫ টাকা হিসাবে এইদিন লোকসান হয়েছে ৮ হাজার ২২৫ টাকা।”
এছাড়া ২৫ জানুয়ারি দিনের প্রথম শিফটে ১৮৯ ঘনমিটার ও দ্বিতীয় শিফটে ১৯ ঘনমিটার কম এসেছে। রাতের শিফটে ৮৮ ঘনমিটার বেশি এসেছে; সব মিলিয়ে কম এসেছে ১২০ ঘনমিটার।
তিনি বলেন, “এ অবস্থা চলতে থাকলে সমস্যার সমাধান না হওয়ার পর্যন্ত স্টেশন বন্ধ রাখার চিন্তা করছে মালিকপক্ষ।
“শীতের তীব্রতা বেড়ে গেলে মূল লাইনের গ্যাস ও বাতাসের মিশ্রণের মধ্যে গ্যাসের উপাদানগুলো নিচে ফ্রিজড হয়ে পড়ে থাকে। তখন কম্প্রেসারে বেশি পরিমাণে বাতাস চলে আসে। এটাই ঘাটতির কারণ।”
মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশে ইউরেকা সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার মো. নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সরবরাহ কমে যাওয়ায় তাদের দুইটি কম্প্রেসার মেশিনের চলা ৮টি লিভারের মধ্যে ৪টি বন্ধ রাখা হয়েছে। রাতে অবশ্য সবগুলো চালু করা যাচ্ছে।
“দুটি কম্প্রেসার মেশিনের জন্য গ্যাসের এক ‘বার’ চাপ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ইদানিং ০.৬০ ‘বার’ চাপ থাকছে। ফলে বাধ্য হয়ে সরবরাহ কমাতে হচ্ছে। ফিলিং স্টেশনে অসংখ্য গাড়ি অপেক্ষা করলেও আমরা সবগুলো লিভার ব্যবহার করতে পারছি না।”
বার হলো চাপের ব্রিটিশ একক। এক ‘বার’ প্রতি বর্গ মিটারে ১০ হাজার নিউটন বলের সমান।
তিতাসের কর্মকর্তা (ডিরেক্টর অপারেশন) ইঞ্জিনিয়ার এইচএম আলি আশরাফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ সঞ্চালন লাইনে সমস্যার কারণে এমন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ওই এলাকায় কয়েকদিন ধরে জিটিসিএল’র কর্মীরা কাজ করছেন।
কিছু সমস্যার সমাধান করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দুয়েক দিনের মধ্যে পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
জিটিসিএল’র বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ ট্রান্সমিশন প্রকল্পের পরিচালক আইনুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সঞ্চালন লাইনে যে সমস্যা ছিল তা ইতোমধ্যেই সমাধান হয়েছে।”
তবে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে কী কারণে সংকট হচ্ছে, তা তিতাসের লোকজন ‘ভালো বলতে পারবেন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।