তবুও অনড় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলের আজ জানাজা-দাফনের জন্যও অবরোধ কর্মসূচি ‘শিথিল’ করা হয়নি। এমনকি আগামীকাল থেকে অবরোধের সঙ্গে আবারও ৩৬ ঘণ্টার হরতাল যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোকোর নামাজে জানাজায় কীভাবে যাবে মানুষ- গতকাল দিনভর এ প্রশ্ন ছিল সর্বত্রই। বিএনপির নেতা-কর্মীরাই বা কীভাবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে জানাজায় অংশ নেবেন- তা নিয়েও বিভিন্ন আলোচনা চলছে। পুত্রশোকে কাতর হলেও অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখনো শক্ত অবস্থানেই রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ অবরোধসহ চলমান আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ সূত্রমতে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের আশঙ্কা- হঠাৎ করে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত রাখা হলে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা নতুন করে বিপদে পড়তে পারেন। টানা অবরোধে ক্লান্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিছুটা সুবিধা নিতে পারে। মাঠের অনেক নেতা-কর্মীই গ্রেফতার-হয়রানির শিকার হতে পারেন। এমনকি জীবননাশের আশঙ্কাও অনেকের। এসব বিবেচনায় অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পক্ষেই বিএনপি জোটের শীর্ষ পর্যায়। বিএনপি নেতারা বলেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করার পর নেতা-কর্মীদের ওপর আরও বেশি জুলুম-অত্যাচার নেমে আসে। অনেকেই গুপ্তহত্যার শিকার হন। গুমও হয়েছেন অনেক নেতা-কর্মী। আজও তাদের কোনো সন্ধান মেলেনি। সার্বিক বিবেচনায় দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানান তারা। অবশ্য বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এও জানান, ‘কোকোর জানাজা ও দাফনের জন্য আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত রাখলে ভালোই হতো। কিন্তু কেন তা করা হলো না, তা আমাদের কারোরই বোধগম্য নয়।’ এ নিয়ে গুলশান কার্যালয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। অবশ্য শোকবিহ্বল বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা বলা যায়নি। নেতারা জানান, কোকোর মৃত্যুতে গায়েবানা জানাজাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের জন্য সারা দেশে আজ অলিখিতভাবে অবরোধ কর্মসূচি কিছুটা শিথিল থাকবে। সূত্র জানায়, বেগম জিয়া পুত্রশোকে কাতর হলেও কর্মসূচি পালনে সরকারকে কোনো ছাড় দেবেন না। গ্রহণযোগ্য একটি নতুন নির্বাচনের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পক্ষে তিনি। কোকোর মৃত্যুর সংবাদের আগে দলের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে নিজের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বিএনপি-প্রধান। কর্মসূচিতে আরও গতি আনতেও সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। অবরোধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে হরতাল কর্মসূচিও। এর মাধ্যমে দাবি আদায় না হলে প্রয়োজনে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে টানা অসহযোগেও যেতে পারে বিএনপি জোট।এদিকে ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এ নিয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, এসএসসি পরীক্ষার সময়ও অবরোধ কর্মসূচি চলবে। কিন্তু পরীক্ষার্থীদের জন্য অবরোধকে আওতামুক্ত করা হতে পারে। যদিও বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিষয়টি আমাদের মাথায় রয়েছে। তবে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই।’ঢাকা মহানগরে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানান, ‘আজ আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় আমরা হয়তো হেঁটে বা অন্য কোনো উপায়ে শরিক হব। কিন্তু দলের বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ নেতারা কীভাবে সেখানে যোগ দেবেন? গাড়িতে করে তারা জানাজায় শরিক হলে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। এ বিষয়টি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের আগেই ভাবা উচিত ছিল। যদিও এসব বিষয় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এখন কোনো কথাবার্তার সুযোগ নেই। কারণ, পুত্রশোকে তিনি এখনো নির্বাক। পরিবারের লোকজন ছাড়া কারও সঙ্গেই তেমন দেখা-সাক্ষাৎ দিচ্ছেন না বেগম জিয়া।’ সর্বসাধারণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শোকের এই দিনে বিএনপির উচিত ছিল কিছু সময়ের জন্য অবরোধ প্রত্যাহার করা। এতে বিএনপির পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জানাজা ও দাফনে অংশ নিতে পারত। বায়তুল মোকাররমে মানুষের ঢল নামত। কিন্তু অবরোধে অনেকেই এতে অংশ নাও নিতে পারেন।দাওয়াত পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী : কোকোর কুলখানিতে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এছাড়া প্রতিটি দলেরই শীর্ষ নেতাদের দাওয়াত করা হবে। আজ কোকোর দাফনের পর থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে বিএনপির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। আগামী শুক্রবার বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে কুলখানির আয়োজন করা হবে।কোকোর দাফন নিয়ে সরকার মন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে না : বনানী সামরিক কবরস্থানে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ দাফনের অনুমতি না দেওয়ার মতো ‘মন্দ দৃষ্টান্ত’ সরকার স্থাপন করবে না বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির মতে সাবেক সেনাপ্রধান ও সামরিক কর্মকর্তার ছেলে হিসেবে কোকোকে সামরিক কবরস্থানে দাফন করা যেতে পারে।গত রাত সাড়ে ৮টায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এসব কথা বলেন।সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে সেনাপ্রধানের ছেলে হিসেবে উনি প্রাপ্য। আমরা ডেথ সার্টিফিকেট ও ছবি দিয়ে নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করেছি। আশা করি আমাদের এ আবেদন গৃহীত হবে। না হওয়ার মতো মন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে না।’ বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলমতের লোকদের আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। দলমত নির্বিশেষে সবাই তার জানাজায় আসবেন। তবে বিএনপির চলমান কর্মসূচি প্রত্যাহারসংশ্লিষ্ট প্রশ্নের জবাব দেননি নজরুল ইসলাম খান।‘যাত্রাবাড়ীর বাসে আগুন সরকারের মাস্টারপ্ল্যান’ : গতকাল এব বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দুঃশাসন টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্র এখন ভয়াল ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র যেন আওয়ামী লীগের তহবিলে কেনা হয়েছে। তাই এ অস্ত্র ব্যবহারে কোনো জবাবদিহিতার দরকার নেই। গতকাল পাঠানো বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগপন্থি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধানরা নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার ছাড়পত্র দিয়েছেন তাদের জওয়ানদের। ‘অস্ত্র, গোলাবারুদ কেন অকেজো করে রাখা হয়েছে’- এ ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করেছেন র্যাবের ডিজি। দেশে এখন বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে নাকি কিছু নেই বলেও উল্লেখ করেছেন র্যাবের এই মহাপরিচালক।রিজভী বলেন, খিলগাঁও ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে কোন বিচারের আওতায় হত্যা করা হয়েছে? কোন আদালতের রায়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বিধবা করা হয়েছে? সপ্তাহখানেক আগে দলের চারজন কর্মীকে ধরে নিয়ে গিয়ে টার্গেট করে বিচারবহির্ভূত এই হত্যা করা হয়েছে জনগণের টাকায় কেনা বুলেট দিয়ে। সরকার নিজেই বড় ধরনের নাশকতা ঘটিয়ে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপাতে পারে বলে বিদেশি অনলাইন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার দুই দিনের মাথায়ই রাজধানীর ডেমরায় বাসে আগুন দিয়ে ৩৫ জন বাসযাত্রীকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো। তার পর দিন শোকে কাতর সন্তানহারা মা বেগম খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা দেওয়া হলো। পুরো ঘটনাটিই সরকারের একটা মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। রিজভী আরও বলেন, পেট্রলবোমা, গানপাউডার, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মানুষ পোড়ানো, লগি-বৈঠার তাণ্ডবে লাশের ওপর নৃত্য ইত্যাদি সর্বনাশা মরণখেলা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।