২০১৪ সাল আফ্রিকার জন্যে কালো বছর হিসেবে গণ্য হতে পারে। হীরের খনি বুকে নিয়েও অভাবের সমুদ্রে তলিয়ে থাকা দেশগুলো ঔপনিবেশিকতা, অশিক্ষা আর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বছরের বছর অতিক্রম করে যাচ্ছে সমাধানহীন। এ বছর সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে এবোলা। মারণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণে ২৯ ডিসেম্বর অব্দি আক্রান্ত হয়েছে ২০,১৫৩ জন। এদের মধ্যে ৭,৮৮৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আক্রান্ত দেশগুলো পশ্চিম আফ্রিকার গণ্ডিমুক্ত হয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অংশবিশেষকেও। ২০১৪ সালে এবোলার মহামারীতে আক্রান্ত আফ্রিকীয় দেশগুলো হলো লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, গিনি, নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল। ইউরোপীয় দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, স্পেন। উত্তর আমেরিকার দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মূলত মার্চ মাসে এবোলার সংক্রমণ তার সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে মর্ত্যে এবং বায়ুর (মিডিয়ার) জগতে প্রবেশ করলেও, ৭০ এর দশকের পর এর নিরব আবির্ভাব ঘটেছে মূলত ২০১৩ এর ডিসেম্বরে। গিনির গুয়েকেদৌ অঞ্চলের হতদরিদ্র এক পরিবারের সন্তান, ২ বছর বয়েসী এক বালকশিশু, চার দিনের জ্বরে ভুগে দেহকোষ ফেটে রক্তক্ষরণে মারা যায়। এর সাত দিন পর মারা যান তার মা। ২০১৩র শেষ মৃত্যুটি ছিল ছেলেটির তিন বছর বয়েসী বোনের। কোন প্রকার চিকিৎসা সেবা নেয়া তখন ঐ পরিবারের পক্ষে সম্ভব হলো না। জানুয়ারি বছরের প্রথম মৃত্যু ঘটলো গুয়েকেদৌর মৃত বালকটির দাদী মার, দিনটি ১ জানুয়ারি। তার বসবাস পার্শ্ববর্তী দেশ সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়ার নিকটবর্তী গ্রাম মেলিয়ানদৌ। তার অন্তেষ্টিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী আত্মীয় স্বজনেরা এলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন এবোলার বীজ। ছড়িয়ে দিলেন, নিজেদেরই অজান্তে। এবোলাবৃক্ষ ডালপালা মেলতে লাগলো। ফেব্রুয়ারি ‘অজ্ঞাত’ রোগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলো গিনির মানুষ। আক্রান্ত হতে থাকলেন স্বাস্থ্যকর্মীরাও। আক্রমণটা ব্যাপক। ছিল আগের আক্রমণগুলোর চেয়েও তীব্রতর। মানুষের বুঝতে তাই একটু সময় লেগে গেল। মার্চ চলতি রহস্যময় রোগ নিয়ে গবেষণার জন্যে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টম গিলবার্ট ২ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার অর্থানুদান নিয়ে বসলেন। গবেষণা চলতে থাকলো। বাইরে তখন রহস্যময় রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর সম্ভাব্যতা ৮৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। গিনির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আক্রান্তদের রক্ত ও মল নিয়ে নিরীক্ষা চালাতে বসলো। বোঝা গেল, এবোলার ফের। ফলখেকো বাদুড়কে পাওয়া গেল, ভাইরাসটির দ্বিতীয় বাহক হিসেবে। উল্লেখ: নিউ ইংল্যান্ড জর্নাল অব মেডিসিন। লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে শনাক্ত করা হলো দুজন দুজন করে রোগী। লাইবেরিয়ার দু জন তখন ধুকছে, সিয়েরা লিওনের দুজন মারা গেছে। গিনিতে মহামারী ঘোষিত হয় এ মাসেই। পৃথিবীর বৃহত্তর মহামারীর ভবিষ্যত রচনা হয়, সেটিও এ মাসে। এপ্রিল গুয়েকোদৌএ স্থাপিত ইউরোপীয় ভ্রাম্যমান গবেষণাগারে একজন বিজ্ঞানী শ্বেত রক্তকণিকা থেকে লোহিত কণিকা পৃথক করে এবোলার রাইবোনিউক্লিক এসিড অণু চিহ্নিত করতে সমর্থ হলেন। সেই সঙ্গে সূচিত হলো এর প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক আবিষ্কারের প্রথম ধাপ। কিন্তু এবোলা ততক্ষণে দুর্দান্ত বেগে এগোচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে রোগটিকে। গণহারে মরতে শুরু করেছে গিনির মানুষ। সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়ায় বেড়ে যাচ্ছে রোগীর সংখ্যা। এবোলা ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও নোবেল বিজয়ী মেডিসিন স্যান ফ্রন্তিয়ারসসহ (এমএসএফ) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো একের পর চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবী দল পাঠাচ্ছে আক্রান্ত দেশগুলোয়। এমএসএফ জানালো চূড়ান্ত ভয়ানক পরিস্থিতির কথা। এপ্রিলে এবোলায় মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশ। মে মে মাসের পরিসংখ্যানে গিনির ২২৬ নতুন আক্রান্তের মধ্যে মারা পড়লো ১৪৯জন। লাইবেরিয়ায় ১৩ আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলো ১১ জন। স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতে থাকলেন। তখনও তাদের সংখ্যা ২৫ জন। জুন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। গিনির একটি এবোলা গবেষণা কেন্দ্রের ৮৬ কর্মী আচমকা অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে পড়লো। এবোলা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলাকালীন অসতর্কতাবশত। লাইবেরিয়ার সমৃদ্ধ রাজধানী মনরোভিয়ার কেন্দ্রীয় হাসপাতাল ছেড়ে রোগীরা চলে গেলেন। এখানে এবোলায় লোক মরছে, সে কারণে। এমএসএফ এর নির্বাহী পরিচালক জানালেন, ‘এবোলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টিকে ঘোষণা দিয়ে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলো। আরও লোকবল ও অর্থবল আরোপ করা হলো গবেষণা বিষয়ে। কিন্তু তারপরও, তা যথেষ্ট ছিল নয় বলেই স্বীকার করলো সবাই। জুলাই আফ্রিকার ১১ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রীরা ঘানায় মিলিত হলো, এবোলা বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনার জন্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সবরকম সহযোগিতা করার পরিকল্পনা গৃহীত হলো। মে নাগাদ মৃতের সংখ্যা গড়ালো ৬৬০এ। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি তুলনামূলক সুসংবাদ শোনালো। এবোলায় মৃত্যুর সম্ভাব্যতা খানিকটা নেমে এসেছে। এখন ৬০ শতাংশ। ২৫ তারিখ উত্তর আমেরিকার প্রথম মৃত হিসেবে নাম লেখালেন মানব হিতৈষী মার্কিন কর্মী প্যাট্রিক সয়্যার। তার বাড়ি মিনেসোটায়। আক্রান্ত হলেন মার্কিন চিকিৎসক গবেষক ড. কেন্ট ব্রান্টলি। সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দিলো লাইবেরিয়া। যেন কেউ বেরোতে না পারে। আর, কেউ না পারে ঢুকতেও। সিয়েরা লিওন আরোপ করলো জরুরী অবস্থা। দুই দেশের রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় সফর বাতিল করলেন। ebola-people_-miguel-funeral মানুষখেকো এবোলা ২০১৪ অগাস্ট সিয়েরা লিওন সেনাবাহিনী নামিয়ে দিলো, মহামারীকালীন শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা আশংকাজনক বেড়ে যাওয়ার কারণে। এছাড়া সেনাবাহিনী স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তা করতে লাগলো। বিমানবন্দরে প্রথমবারের মতো কোয়ারেন্টাইন কক্ষ বসানো হল। কোয়ারেন্টাইন কক্ষের ফাঁকফোকর গলে কয়েকজন এবোলা পজিটিভ যাত্রী বেরিয়ে, চলে গেলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বারাক ওবামা আফ্রিকার নেতাদের নিয়ে সর্ববৃহৎ সম্মেলন আহ্বান করলেন, এমনটা ইতোপূর্বে আর কোন মার্কিন রাষ্ট্রপতি করেননি। সম্মেলনের স্লোগান ছিল, ‘বিনিয়োগ করুন, পরের প্রজন্মের তরে।’ বিশ্বব্যাংক বিশ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলো। স্পেনের প্রথম মৃত্যু। শিকার, ধর্মগুরু মিগুয়েল পাজারেস। ড. কেন্ট ব্রান্টলি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন। বললেন, ‘কী বিচিত্র! মিরাকল রীতিমতো!’ গিনি ও লাইবেরিয়া সংলগ্ন সীমান্ত বন্ধ করে দিলো আইভরি কোস্ট। ততদিনে সব মিলিয়ে ১৫৫২ জন মারা গেছেন। সেপ্টেম্বর বারাক ওবামা এবোলা সংক্রমণকে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে ঘোষণা করলেন। পূর্বের প্রদানকৃত ১০ কোটি মার্কিন ডলারের সঙ্গে আরও ১ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা হিসেবে যুক্ত করলেন। ইউএসএআইডি যোগ করলো আরও সাড়ে সাত কোটি মার্কিন ডলার। এভাবে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিপুল অর্থ সহায়তা আসতেই থাকলো। নাইজেরিয়া ও সেনেগালে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র সিডিসি ঘোষণা করলো আসছে বছরের জানুয়ারী নাগাদ সাড়ে ৫ লাখ মানুষ এবোলা আক্রান্ত হবে। নীরিক্ষামূলক এবোলা প্রতিষেধক চিকিৎসকদের হাতে এলো। নাম টিএমকে-এবোলা। ততদিনে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়েছে। অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে প্রথমবারের মতো কোয়ারেন্টাইন কক্ষ স্থাপন। ইতোমধ্যে ডালাসে চিকিৎসা গ্রহণরত টমাস এরিক ডানকানের কাছ থেকে সেবিকা নিনা ফামের শরীরে সংক্রমিত হয় এবোলা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা এটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, মৃতের সংখ্যা ছাড়ালো ৫০০০। নভেম্বর এবোলার প্রতিষেধক কার্যকারিতা প্রকাশ করতে থাকলো। কিন্তু মৃতের সংখ্যা কমলো না আফ্রিকায়। নভেম্বরের কুড়ি নাগাদ আক্রান্তের সংখ্যা ১৫,১৪৫ । মৃতের সংখ্যা ৬,৩৮৮। ডিসেম্বর প্রতিষেধক নিয়ে এখনও গবেষণা হচ্ছে। ২৯ ডিসেম্বর অব্দি আক্রান্ত হয়েছে ২০,১৫৩ জন। এদের মধ্যে ৭,৮৮৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এবোলা তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। দেখা যাক, ২০১৫তে আমাদের জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে।