হবিগঞ্জের সাতছড়ির গহিন বনে অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদের শেষ নেই। গতকাল সকাল থেকে পরিচালিত অভিযানে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। সাতছড়ির গভীর বনে অভিযানকালে র্যাব সদস্যরা তিনটি টিলার সাতটি গর্ত থেকে ব্যারেলসহ মেশিনগানের ৫৪ রাউন্ড ও রাইফেলের ৬৩৩ রাউন্ড গুলি এবং ছয়টি সিডি উদ্ধার করে। সোমবার বেলা ১২টায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র্যাব-৯ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল মুফতি মাহমুদ এসব তথ্য জানান। এ সময় র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সানা শামিনুর রহমান এবং এএসপি ফজলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, সোমবার সাতছড়ির গভীর বন থেকে এসব অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত সাতছড়ি অভয়ারণ্যের আরও দুর্গম পাহাড়-টিলায় র্যাবের অভিযান অব্যাহত ছিল। রবিবার থেকে শুরু হওয়া র্যাবের অভিযানে কাঁড়ি কাঁড়ি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারসহ মাটির নিচে কাঁচা-পাকা ক্যাম্পগুলো আবিষ্কারের ঘটনায় র্যাব কর্মকর্তারাও অবাক হচ্ছেন। বনের ঝোপ-ঝাড়, পাহাড়-টিলার আড়ালে আড়ালে গড়ে তোলা রয়েছে আস্তানা। আশপাশের টিলায় গভীর পরিখা খনন করে নির্মাণ করা হয়েছে অত্যাধুনিক বাঙ্কার। কিন্তু সবগুলো আস্তানাই ‘পরিত্যক্ত’ অবস্থায় আবিষ্কৃত হলেও বাঙ্কারগুলো ছিল অস্ত্র-গোলাবারুদে ঠাসা। সেসব স্থানে একসময় সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের ব্যাপক আনাগোনা ও স্থায়ী অবস্থান করার নানা নমুনা বিদ্যমান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ আস্তানা ও বাঙ্কারে কারও অবস্থান বা যাতায়াত ছিল না বলেই মনে করছেন র্যাব কর্মকর্তারা।এর আগে ৩ জুন সাতছড়ির গভীর অরণ্যে দুটি টিলার নয়টি বাঙ্কার থেকে একটি রকেট লঞ্চার, ৪০ মিমির ২২২টি রকেট, ২৪৮টি রকেট চার্জার, চারটি মেশিনগান, মেশিনগানের পাঁচটি ব্যারেল, ১২ হাজার ৯৮৭ রাউন্ড বুলেটসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার হয়। এর পরও র্যাব সদস্যরা যতই বনের গভীরে ঢুকছেন ততই দেখতে পাচ্ছেন পরিত্যক্ত বাড়ি আর দুর্ভেদ্য বাঙ্কার। মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকলেই বেরিয়ে আসছে একের পর এক মারণাস্ত্র, গোলাবারুদ। এত সব ভারী অস্ত্রের মজুদ দেখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। সবার মুখে একই প্রশ্ন, আর কত অস্ত্র-গোলাবারুদের মজুদ আছে সাতছড়িতে! টানা এক সপ্তাহ ধরে অভিযানসহ অস্ত্র-গোলাবরুদ উদ্ধার অব্যাহত থাকলেও সাতছড়ির পাহাড়-টিলা, গহিন অরণ্যে কারা এত অস্ত্র মজুদ করেছিল, কী উদ্দেশ্য ছিল তাদের, সেসবের কিছুই জানাতে পারছে না র্যাব। র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক সানা শামিনুর রহমান জানিয়েছেন, সাতছড়ি উদ্যানের সব টিলা ও পাহাড়ে অনুসন্ধান চলছে। র্যাবের বিপুলসংখ্যক সদস্য সন্দেহভাজন পাহাড়-টিলা কর্ডন করে রেখেছেন।
এদিকে সাতছড়িতে রবিবার পর্যন্ত উদ্ধার অস্ত্রগুলো ঢাকার সেন্ট্রাল এমুনেশন ডিপো ও সেন্ট্রাল অর্ডিন্যান্স ডিপোতে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে র্যাবের ডিএডি বাদী হয়ে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেছে। এ ঘটনায় এখনো কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি বলেও জানিয়েছে র্যাব সূত্র। তবে গতকাল আবিষ্কার হওয়া কথিত পরিত্যক্ত বেশ কয়েকটি ঘরে মানুষজনের সদ্য আনাগোনার নজির পাওয়া গেছে। ঘরের আশপাশে গড়ে তোলা সবজি বাগানগুলো দেখে চার-পাঁচ দিন আগেও সেখানে মানুষ অবস্থান করেছে বলে সংবাদকর্মীরা ধারণা করছেন।
ক্যাম্প কমান্ডার সুনীল দেব বর্মা! : বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতছড়ির গহিন অরণ্যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ত্রিপুরা পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (টিপিডিএফ), ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (এনএলএফটি), ইউনাইটেড লিবারেশন অব আসাম (উলফা), অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ), ট্রাইবাল ফোর্স, ত্রিপুরা কিংডম, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ), রয়েল বরাক আর্মি (আরবিএ), পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ও প্রিপাক-এর আনাগোনা ছিল। সাতছড়ি টিপড়া আদিবাসীদের একটি পুরনো আবাসস্থল। তাদের সঙ্গে মিলেমিশেই অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। অনুসন্ধানকালে জানা যায়, অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ) কর্তৃক পরিচালিত সাতছড়ির অন্যতম আস্তানাটির প্রধান কমান্ডার হিসেবে সুনীল দেব বর্মা নামে একজন উগ্রপন্থি নেতা দায়িত্ব পালন করতেন। এর আগে ২০০৫ সালে মৌলভীবাজারের মেন্দিটিলা পোড়াবাড়ীতে র্যাবর কমান্ডো অভিযানে ছয়জন উগ্রপন্থি নিহত এবং সুনীল দেব বর্মাসহ আরও আটজন গ্রেপ্তার হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালী একটি মহলের তৎপরতায় সুনীল দেব বর্মা জামিনে মুক্তি পেয়েই মৌলভীবাজার জেলা এলাকা ছেড়ে হবিগঞ্জের সাতছড়িতে নতুন আস্তানা বানিয়ে অবস্থান শুরু করেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০০৮ সালের শেষ দিক থেকেই উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সবকিছু ফেলে সুনীল দেব বর্মা ও তার অনুসারী দুই শতাধিক অস্ত্রবাজ বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে ত্রিপুরার গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে