বাজারভর্তি মৌসুমী ফলমূলে ॥ বিষাক্ত ফরমালিন

0
126
Print Friendly, PDF & Email

০ নেই সমন্বিত অভিযান
০ অবাধে মেশানো হচ্ছে রাসায়নিক
০ দ্রুত জটিল রোগ ছড়াচ্ছে
০ জন্ডিস লিভার কিডনি নষ্ট হওয়া ছাড়াও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাচ্ছে
০ আম জাম লিচু পেয়ারা থেকে সাবধান!
শাহীন রহমান ॥ সম্প্রতি শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকার এক মহিলা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও ডাক্তার তাঁর রোগ ধরতে পারেননি। বাধ্য হয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তিনি সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায় তাঁর শরীরে ফরমালিনের উপস্থিতি অনেক বেশি। তার দেহে ফরমালিনের উৎস যে খাদ্যদ্রব্য থেকে এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ থেকেই বোঝা যায় দেশে ফরমালিনের বিস্তার কতটা ভয়াবহ।
কঠোর নজরদারি না থাকায় খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত ফরমালিনের এ ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও ফরমালিন মেশানোর এ প্রবণতা অনেক আগ থেকেই শুরু হয়েছে। যা মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করছে। এখন সব ধরনের ভোগ্যপণ্যেই ফরমালিনের উপস্থিতি মিলছে। বাজারে মৌসুমী ফলেও ব্যাপক ফরমালিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে আম থেকে শুরু করে মৌসুমী ফল জাম, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদিতে অবাধে ফরমালিন মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যেসব প্রতিষ্ঠান বা রাজধানীর বিখ্যাত সুপার শপগুলো যারা বিষমুক্ত বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করে থাকে তাদের দোকানেও পরীক্ষা চালিয়ে ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিদেশী থেকে আমদানি হয়ে আসা আপেল ও আঙ্গুরেও মিলছে ফরমালিন।
গত এক সপ্তাহ ধরে বিএসটিআইয়ের যতগুলো অভিযান হয়েছে প্রত্যেক অভিযানে মৌসুমী ফলসহ বলা যায় প্রতিটি ভোগ্যপণ্যেই ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মধুমাস হওয়ায় ঢাকাসহ সারাদেশেই এখন মৌসুমী ফলে ব্যাপক সরবরাহ রয়েছে। এসব মৌসুমী আম, জাম, জামরুল, লিচু পেয়ারা রসাল ফল হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ক্রেতাও সহজেই এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ঢাকার বিভিন্ন অংশে মৌসুমী ফলে দোকানের পাশাপাশি আম মেলায়ও ফরমালিনমুক্ত আম হিসেবে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশী ফল হিসেবে বাজারে বিক্রি হওয়া আপেল ও আঙ্গুরেও ব্যাপক ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ অভিযানে গুলশানসহ আগোরা, রাজধানীর বিভিন্ন সুপারশপ, মতিঝিলের ইস্পাহানী ফুড গার্ডেন, খিলগাঁও এলাকার তালিয়া ট্রেডার্স, বিল্লালের ফলের দোকানের আমে, এ্যলিফ্যান্ট রোডের নূর হোসেনের ফলের দোকানে আম, পেয়ারা, লিচু, হাতিরপুলে আল্লাহর দান স্টোরের আঙ্গুর, আম, লিচু, কলাবাগানে মোহাম্মদ লায়েকের দোকানে আম লিচু, এলিফ্যান্ট রোডের মোহাম্মদ রাজুর ফলের দোকানে অভিযান চালিয়ে ফরমালিনের ব্যাপক উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটা গত এক সপ্তাহের অভিযানে।
দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরেই খাদ্যে ভেজাল ও ফরমালিন রোধে পরিচালিত হয়ে আসছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অথচ এত অভিযান, এত জরিমানা তার পরও খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের বিরুদ্ধে জোরদার কোন অভিযান না থাকায় সহজেই ব্যবসায়ীরা ফলমালিন মিশিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযান চলছে তা অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে। বিশেষ করে বিএসটিআই, সিটি কর্পোরেশন ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা এসব অভিযান চলেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। ফলে খাদ্যের ভেজালের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাচ্ছে না। মূলত এর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার না হওয়া, অভিযানে কোন সমন্বয় না করা এবং অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না করার ফলেই খাদ্যে ভেজালের প্রবণতা অনেকে বেড়ে গেছে।
বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক মোঃ রিয়াজ বলেন, প্রত্যেকদিনই বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। ফরমালিন রোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যাপক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুই একদিনের মধ্যে ঢাকার আটটি প্রবেশপথে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত চেকপোস্ট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যাতে কোন প্রকার ফরমালিনযুক্ত ফল ঢাকা প্রবেশ করতে না পারে। যেখানেই চেকপোস্টে কোন ফরমালিন মেশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে সেখানেই ধ্বংস করা হবে।
সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জোরদার নজরদারির ব্যবস্থা না থাকায় ফরমালিন মেশানোর প্রবণতা আরও বাড়ছে। তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ভেজালবিরোধী অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অভিযানে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অভিযানের সময় প্রয়োজনমতো পুলিশ চাইলেও পাওয়া যায় না। ফলে বড় কোন অভিযান না চালিয়েই অনেক সময় ফিরে আসতে হয়। তবে তিনি উল্লেখ করেন সিটি কর্পোরেশেনের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই একাধিক টিমের অভিযান চলছে।
দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে প্রতিদিনই ঢাকায় আসছে মৌসুমী ফল। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, আমের বাগান থেকেই মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ রাসায়নিক দ্রব্য। যাতে এক রাতের মধ্যে আম পেকে যায়। আবার ঢাকায় আসার পরে এসব ফলে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে যাতে সহজেই না পচে। বিশেষজ্ঞদের মতে পচন রোধ ও সহজে পাকানোর জন্য রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী লাভবান হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ছে মানবদেহে। ফলে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। অথচ খাদ্যদ্রব্যে বিশেষ করে মৌসুমী ফলে রাসায়নিক পদার্থ মেশানো বন্ধে অনেক আগেই আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রায়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নজর রাখতে বলা হয়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। ফলে স্থানীয় পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত সব জায়গায় মৌসুমী ফলসহ খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের অবাধ ব্যবহারও চলছে।
শুধু দেশীয় ফল নয় অভিযানে দেখা গেছে বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে যেসব ফল বাজারে বিক্রি হয় সেসব আপেল, আঙ্গুরেও রয়েছে ফরমালিনের উপস্থিতি। সারাবছরই ফলকে তাজা রাখতে ফরমালিনের চেয়ে উপাদেয় ব্যবসায়ীদের কাছে আর কিছু নেই। অথচ আমাদানি পর্যায়ে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যে গুণগতমান পরীক্ষার জন্য আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে এনবিআরকে এ বিষয়ে দেখভালের কথা বলা হয়েছে। এর পর বিদেশ থেকে আসা ফলসহ খাদ্যদ্রব্যে ফলমালিনসহ অন্য রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, কারা কিভাবে বিদেশী এসব ফলে ফরমালিন মেশাচ্ছে তার কোন সঠিক তথ্য না পাওয়ায় এর বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশ থেকে আমাদানি হয়ে আসা কার্টন পরীক্ষা করেও আঙ্গুর ফলে ফরমালিন পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আসা এসব সামগ্রী বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের কোন ছাড়পত্র নিতে হয় না। ফলে কারা কিভাবে ফরমালিন মেশাচ্ছে তা বের করাও বিএসটিআইয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, এনবিআর থেকে যদি কাস্টমস পর্যায়ে এসব পণ্যের গুণগতমান পরীক্ষা করা হতো তাহলে বিষয়টি ধরা যেত।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বিদেশী ফলমূল দেশে আসার পর কাস্টমস ছাড়পত্র নিয়ে সরাসরি কোল্ডস্টোরেজগুলোতে রাখা হয়। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন পাইকারী আড়ত হয়ে খুচরা বাজারে চলে আসে এসব ফলমূল। কিন্তু আমদানি হয়ে আসার পর গুণগতমান পরীক্ষা না করায় কখন, কারা কিভাবে এতে ফরমালিন মেশাচ্ছে তা সহজে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফরমালিন এমন একটি পদার্থ যার বহুল ব্যবহার রয়েছে দেশে। বিশেষ করে প্রিজারভেটর হিসেবে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। মেডিক্যাল কর্মকা-ের জন্য ফরমালিনের ব্যবহার করা হয় বেশি। খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন ব্যবহার স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের কোন দেশেই খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য ফরমালিনের ব্যবহার নেই। আবার ফরমালিন এমন এক রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যদ্রব্যে যার সহনীয় কোন মাত্রা নেই। যেকোন পরিমাণে ফরমালিন খাদ্যদ্রব্যে মেশানো হোক না কেন তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।
কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীর ফলসহ খাদ্যদ্রব্যে বিষ মিশিয়ে লাভবান হলেও প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে ক্রেতা বা ভোক্তারা। তাদের মতে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো ফল খেয়ে মানুষ দীর্ঘমেয়াদী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বদহজম, পেটেরপীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্টিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়ার মতো জটিল রোগের শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব রাসায়নিক পদার্থের কারণে মহিলারা যেমন বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দিতে পারে। শিশুরাও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া রাসায়নিক মেশানোর ফলে পুষ্টি ও স্বাদ উভয়ই নষ্ট হয়ে যায়। অথচ মৌসুমৗ এসব ফল মানুষের পুষ্টির চাহিদা অনেকাংশেই পূরণ করে থাকে।
তাদের মতে, বিজ্ঞানের অপব্যবহারের কারণেই মূলত খাদ্যে ভেজালসহ বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। আর এ কাজে জড়িত দেশের কতিপয় বিজ্ঞানী। তারা কতিপয় অস্বাদু ব্যবসায়ীদের মাঝে বিজ্ঞানের অপব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। নইলে কোন সাধারণ ব্যবসায়ীর জানার কথা নয় ফরমালিন কি কি কাজে ব্যবহৃত হয়। অথচ ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মেশানোর মতো কাজ করছে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারের সুযোগ ব্যবসায়ীরা নিলেও তারা এর ফল সম্পর্কে কিছুই জানে না। অথচ যারা এ সম্পর্কে অবগত সেই বিজ্ঞানীরাই দায়িত্বজ্ঞানের সঠিক পরিচয় দিচ্ছেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযানে জেল জরিমানা করা হলেও মূল বিষয়টি কখনো খুঁজে বের করা হয়নি। ফলে অভিযানের ফলেও ভেজাল রোধে কোন কার্যকর ফল বয়ে আনেনি।
তাদের মতে, আগামী প্রজন্মকে সুস্থ সবল ও মেধামননে গড়ে তুলতে হলে নিরাপদ খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। নিরাপদ খাদ্য মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ভেজালের বিরুদ্ধে একযোগে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখনই জরুরী হয়ে পড়ছে।

শেয়ার করুন