গহিন বনে পরিত্যক্ত বাড়ি

0
137
Print Friendly, PDF & Email

চারদিকে শুধু ঘন বৃক্ষরাজি, ঝোপঝাড়। দিনের আলোও সেখানে প্রবেশ করে না। গা ছম-ছম করা বিভিন্ন কীটপতঙ্গের শব্দে শুধুই আতংক। সাড়ে তিন হাজার একর জমির ওপর সাতছড়ি জাতীয় এ উদ্যানে ছোটবড় পাহাড়ের সংখ্যা তিন শতাধিক। এর মধ্যে কমপক্ষে অর্ধশত পাহাড় এক সময় ছিল ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। বহু বছর ধরেই এ পাহাড়গুলোকে তারা ব্যবহার করেছে নিজেদের আস্তানা হিসেবে। সমতলের মানুষ তো বটেই, পাহাড়ী জনগোষ্ঠীরও সেখানে যাওয়া ছিল মানা। অনেক পাহাড়ে প্রবেশের পথে বড় করে লেখা রয়েছে ‘বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।’ এমনই সব পাহাড় এখন জনমানবশূন্য। পাহাড়ের চূড়ায় অসংখ্য বাড়িঘর দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত। রোববার থেকে সমতলের প্রায় আধা কিলোমিটার দূরত্বে র‌্যাব সদস্যরা দুটি পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। বাকি পাহাড়গুলোতে অনুসন্ধানের প্রস্তুতি নিচ্ছে র‌্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।
শুক্রবার যুগান্তরের পক্ষ থেকে গহিন অরণ্যে এসব ছোট-বড় বেশ কয়েকটি পাহাড়ে অনুসন্ধান চালিয়ে এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার নীরব সাক্ষীর ছবি দেখা গেছে। যুগান্তরের হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন, চুনারুঘাট প্রতিনিধি আবুল কালাজ আজাদ ও মাধবপুর প্রতিনিধি রোকন উদ্দিন লস্কর এ অনুসন্ধান টিমে ছিলেন।
পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ঝোপঝাড়ের ভেতর পরিত্যক্ত অনেক বাড়ি। আশপাশে রয়েছে নিরাপত্তা চৌকিসহ বেশ কিছু বাংকার। বৃষ্টিপাতে বাংকের মাটি ধসে আংশিক বন্ধ হয়ে গেছে। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর কাছে ‘উগ্রপন্থী টিলা’ নামে পরিচিত একটি পাহাড়ে গিয়ে দেখা মিলল অনেক আগে তৈরি করা বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিপ্লবীদের মূল ঘাঁটি। বাড়ি এবং ক্যাম্পের চারপাশে রয়েছে বিশাল ঝোপঝাড়। সাপ ও বানরের দেখা মিলল সেখানে। দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত বাড়ির স্যাঁতসেঁতে উঠানে নামতেই ভয়ংকর একটি শব্দে সবাই আঁতকে ওঠে। খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে শব্দ ভেসে আসছিল- সাবধান, সাবধান। কখনও অনুমান হচ্ছিল মানুষের শব্দ আবার কখনও মনে হচ্ছিল এটি পাখি বা বন্যপ্রাণীর ডাক। ত্রিপুরা পল্লী থেকে পাহাড়মুখী হওয়ার সময়ই টিমের সঙ্গী বন্য কুকুরও শব্দে কিছুটা দিশেহারা। শব্দের উৎসের সন্ধানে কুকুরও শুরু করে ছোটাছুটি। কুকুরের পেছনে গিয়েই পাওয়া গেল শব্দের উৎসস্থল। ময়নার আদলে একটি পাখি এভাবেই ডাকছিল। কোনো এক সময়ে পোষমানা পাখিটিকে হয়তো সাবধান শব্দটি শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। পাখিটি মালিক সঙ্গে না থাকলেও শেখানো শব্দটি ভুলতে পারেনি। হতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই নিজেদের স্বার্থে পাখিটি পোষ মানিয়েছিল। আস্তানা ফেলে যাওয়ার সময় ছেড়ে দিয়ে গেছে পাখিটিকে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চলে গেলেও আস্তানা ছাড়েনি পাখিটি। হয়তো মানুষ দেখেই শেখানো বুলি আওড়ানো শুরু করেছে সাবধান সাবধান।
উঠোন পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই পাওয়া গেল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গোপন জীবনের নানা প্রমাণ। আধভাঙা ডাইনিং টেবিল। ডাইনিং রুমের পাশে কিচেনে যেতেই দেখা গেল বিশাল আকৃতির কয়েকটি চুলা। এ থেকেই অনুমান করা যায় এ আস্তানায় এক সময় লোক সমাগম ছিল অনেক বেশি। ঘরের ভেতর পাওয়া গেল ইংরেজি ও ত্রিপুরী ভাষায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণের বিভিন্ন বই, উগ্রপন্থীদের নিয়ে ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের কাটিং, আইন-চিকিৎসার বইসহ অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার বিভিন্ন বেল্ট ও খাঁপ। পাহাড়ের ওপর মূল এ আস্তানা ঘিরে অসংখ্য বাংকার। প্রায় আধ ঘণ্টা অবস্থানের পর উগ্রপন্থী টিলা থেকে নেমে কথা হয় ত্রিপুরা পল্লীর জনগণের সঙ্গে। পাহাড়ের চূড়ায় বাংকারের কথা বলতেই এক বৃদ্ধ বললেন সে অনেক আগের কথা। একসময় বিপ্লবীরা এখানে এসে আশ্রয় নিত। গোপনে থেকে আবার চলেও যেত। তার দীর্ঘ জীবনে কোনো দিন এই পাহাড়ে গুলির শব্দ শুনেননি। ট্রেনিংয়ের জন্য কাউকে দৌড়ঝাঁপও করতে দেখেননি বলে যুগান্তরের টিমের কাছে নিশ্চিত করেন তিনি।
ত্রিপুরা পল্লীর পার্শ্ববর্তী লাল টিলায় ফিরে কথা হয় র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে। ওই টিলাতেই গত চার দিন ধরে অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব। ওই টিলায় একটি বাংকার থেকেই উদ্ধার হয়েছে সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ। সেখানে আরও সাতটি বাংকারে এখনও খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। লাল পতাকা উড়িয়ে র‌্যাব সদস্যরা সেখানে সতর্ক প্রহরায় রয়েছেন। ওই টিলায় দায়িত্বরত র‌্যাব কর্মকর্তা এসআই কাজল যুগান্তরকে জানান, তারা অভিযানস্থলের বাইরে অন্য কোনো টিলায় এখনও যাননি। সেসব টিলায় কি আছে না আছে তা তাদের জানা নেই।
ত্রিপুরা পল্লীর বাসিন্দারা যা বললেন : নাম প্রকাশ না করার শর্তে ত্রিপুরা পল্লীর একাধিক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে যুগান্তরকে বলেছেন, এসব পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অনেক আগে মাঝেমধ্যে আসত। একথা প্রায় কেউ জানত না। ওই বাসিন্দারা বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এসব টিলায় এসে দু’একদিন করে থাকলেও তাদের পল্লীর অধিকাংশই জানত না। যে দু’একজন জানত ভয়ে মুখ খুলত না। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা নীরবতা পালন করেছেন। ত্রিপুরা পল্লীর বাসিন্দারা বলেন, ২০০৫ সালের পর থেকে তাদের আনাগোনা প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। এ সময় আইনশৃংখলা বাহিনী এসব এলাকায় জোর তল্লাশি শুরু করে। ২০০৭ সালের পর থেকে একদম শান্ত। এরপর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিপ্লবী কারও দেখা মেলেনি এই এলাকায়। তবে একটা সময় ছিল চাপে বা লোভে পড়ে ত্রিপুরা পল্লীর কেউ কেউ হাত মেলায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে। বিনিময়ে তারা প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকাও পেয়েছে। সেই টাকার জোরে ভাগ্যবদলানোর রেশ এখনও বিদ্যমান। যে হাত মিলিয়ে টাকা বানিয়েছে সেই নেই। তবে তার পরিবারের সদস্যরা আরামে দিন কাটাচ্ছে। তার নমুনা দেখা মিললো সরেজমিনে গিয়ে।
পেশায় বন বিভাগের ভিলেজার (বন পাহারাদার) হলেও তাদের ঘরে গিয়ে দেখা যায় আভিযাত্যের ছোঁয়া। বিদ্যুৎ না থাকলেও সৌর বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে প্রায় ঘরেই। এ পল্লীতেই সোমবার দুটি বাংকার আবিষ্কার করে র‌্যাব। এর একটি ওই পল্লীর বাসিন্দা সুরেষ দেব বর্মার মালিকানাধীন ঘরের নিচে। অপরটি শম্ভু দেব বর্মার মালিকানাধীন বাড়ির নিচে অবস্থিত। প্রথমটিতে কিছু না পেলেও দ্বিতীয়টিতে মিলেছে সেনাবাহিনীর পোশাকের আদলে বিপুল পরিমাণ কাপড়, বোতাম, সেলাই মেশিন, বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের লিফলেট, তাদের ভাষায় রাজস্ব (চাঁদা) আদায়ের রসিদ, বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের প্যাড।
ত্রিপুরা পল্লীতে আভিযাত্যের ছোঁয়া : অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে জানা গেল এ পল্লীরই বাসিন্দা সচিত্র দেববর্মার ছেলে আশীষ দেববর্মা বিলাসী জীবনযাপনের মোহে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এটিটিএফ’র (অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স) সঙ্গে হাত মিলায়। ত্রিপুরা পল্লীর তৎকালীন হেডম্যান (তাদের মন্ত্রী) চাচা যোগেশ দেববর্মার মাধ্যমেই এ দলে ভিরে। এর পরেই রাতারাতি তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এটিটিএফ’র টাকায় একটি ট্রাক কিনে। যার নম্বর ‘ঢাকা মেট্রো ট-১১-৩৩৬৬’। এ ট্রাকে করেই ওই সময় সাতছড়ির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আস্তানা থেকে সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ পৌঁছে দিত দেশের অন্যান্য অঞ্চলে থাকা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের হাতে। আনারসসহ বিভিন্ন ফল বোঝাই ট্রাকে করে অস্ত্র সরবরাহ করা হতো। এমনই একটি চালান ২০০৩ সালের ২৬ জুন বগুড়ার কাহালুতে ধরা পড়ে। ট্রাকের চালক আলতু মিয়া ধরা পড়লেও পালিয়ে যায় আশীষ দেববর্মা। এরপর থেকেই সে মূলত পলাতক। তবে মাঝে মাঝে পল্লীতে যাতায়াত করত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। শুক্রবার ওই পল্লীতে আশীষ দেববর্মার বাড়িতে গিয়ে এর সত্যতা মিলেছে। বাড়ির বাড়ান্দায় পাওয়া গেছে তার ব্যবহৃত নম্বরবিহীন একটি মোটরসাইকেল। সুসজ্জিত তার ঘরে রয়েছে দামি কয়েক সেট সোফাসহ অন্যান্য আসবাবপত্র। ওই সময় এখানে মাঝেমধ্যেই সে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে বৈঠক করত এমন তথ্যও মিলেছে।
যেভাবে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসত : স্থানীয় সূত্রগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত থেকে মশার কয়েল তৈরির প্রধান উপকরণ মেন্দা গাছের ছালভর্তি বস্তার ভেতর করেই অনা হতো অবৈধ অস্ত্র। ভারত থেকেই তারা এ অস্ত্রগুলো সাতছড়ির এ গহীন অরণ্যে নিরাপদ আস্তানায় নিয়ে আসে। কৌশলে বিডিআর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আনা হতো এ ধরনের বস্তা।

শেয়ার করুন