নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাকরিচ্যুত র্যাব-১১’র সাবেক কর্মকতা নৌবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানা তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, জিয়া নামে র্যাবের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুযায়ীই হত্যার পুরো ঘটনাটি সংঘটিত হয়।
নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসাইন খান বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
সাতজনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত দুটি মামলার বাদীপক্ষের একজন আইনজীবী হলেন সাখাওয়াত। মামলা দুটোর বাদীপক্ষে রয়েছেন নিহত আওয়ামী লীগ নেতা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারের পরিবারের সদস্যরা।
বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দীনের সামনে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন রানা। একটি সূত্র জানিয়েছে, রানার স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রায় ৩০ পৃষ্ঠার।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে রানাসহ র্যাব-১১’র সাবেক তিন কর্মকর্তাকে কিছুদিন আগে গ্রেফতার করা হয়। এই তিনজনের মধ্যে শুধু র্যাব-১১’র প্রধান চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দেননি। আর আরেক গ্রেফতারকৃত সাবেক র্যাব কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসাইন গত বুধবার দুটি মামলায় পৃথক দুটি স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।
সাখাওয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী- কিভাবে অপহরণ করা হয়েছিল, অপহরণের পর অপহৃতদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কোথায় ও কিভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছিল, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা কারা জড়িত ছিলেন এবং হত্যার নির্দেশ কারা দিয়েছিলেন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন আরিফ এবং রানা। এমনকি কোথা থেকে ও কিভাবে ইট, বস্তা ও রশি সংগ্রহ করা হয়েছিল, কিভাবে মৃতদেহগুলোকে বাঁধা হয়েছিল, অপহরণের সময় ও হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে কোন কোন যানবাহন ব্যবহার করা হয়েছিল এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে মৃতদেহগুলো কিভাবে ফেলে দেয়া হয়েছিল এসবকিছু সম্পর্কেই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে জানিয়েছেন তারা।
আইনজীবী সাখাওয়াত বলেন, “আরিফ ও রানা নিজেরা যে বাহিনীর হয়ে কর্মরত ছিলেন সেই নির্দিষ্ট বাহিনীরটিরই একটি শীর্ষ পদে কর্মরত এক কর্মকর্তার নামও উল্লেখ করেছেন তারা। ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম জিয়া বলে জানিয়েছেন তারা এবং অপহরণ ও হত্যার আদেশও এই জিয়াই তাদের দিয়েছিলেন।”
‘নির্দিষ্ট বাহিনী’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন জিজ্ঞেস করা হলে সাখাওয়াত জানান, নির্দিষ্ট বাহিনী বলতে তিনি র্যাবকেই বুঝিয়েছেন। কারণ গ্রেফতারকৃত সাবেক তিন কর্মকর্তা ওই বাহিনীটিতেই কর্মরত ছিলেন।
একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সাখাওয়াত জানান, গ্রেফতারকৃত ওই তিন কর্মকর্তা বারবারই একথা বলে আসছিলেন যে, অপহরণ ও হত্যার ওই আদেশ শীর্ষ পদে কর্মরত এমন একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে তারা পেয়েছিলেন যা অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।
তবে এতকিছু জানালেও জিয়া নামের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার র্যাংক ও পদবি কী তা নির্দিষ্ট করে জানাননি সাখাওয়াত। কিন্তু বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে গত ২৭ এপ্রিল যখন এই অপহরণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে, তারপরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে এলিট ফোর্স হিসেবে খ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান সাত ব্যক্তিকে হত্যার এই ভয়াবহ ও লোমহর্ষক ঘটনা নিয়ে তার কিছু মন্তব্যের কারণে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন।
নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম প্রথম থেকেই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার দায় চাপিয়ে আসছিলেন র্যাবের ওপর। ফলে শহীদুলকে নিয়ে বেশ কিছু পাল্টা-আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছিলেন জিয়া, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবার জিয়াকে আক্রমণ করে শহীদুলের উত্তর-এভাবেই শহীদুল ও জিয়ার পারস্পরিক এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণাত্মক বক্তব্য সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
সে সময় কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেছিলেন- বীভৎস এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন গত ২ মে বেনাপোল সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছেন বলে তাদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে এবং নূর সে সময় ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছিল বলেও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। একবার নূর হোসেনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেই এই অপহরণ ও হত্যাকে ঘিরে গড়ে ওঠা রহস্যের পর্দা উন্মোচন করা সম্ভব হবে বলেও সে সময় মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলামের কোনো ভূমিকা আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল।
অন্যদিকে শহীদুল অব্যাহতভাবে অভিযোগ করছিলেন যে, নূর হোসেনকে দেশ থেকে পালাতে সহায়তা করেছেন খোদ র্যাবের এডিজি কর্নেল জিয়াউল। এরই ধারাবাহিকতায় অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র্যাব-১১’র তিন কর্মকর্তা ছাড়াও র্যাবের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন বলেও দাবি করেন শহীদুল।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমানের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “১৬৪ ধারায় কে কী বলেছেন না বলেছেন তা তো আমি জানি না। স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে যদি কারো নাম এসেও থাকে তাহলে সে বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্তৃপক্ষের।”
র্যাবের অতিরিক্ত ডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গতকাল রাতে ফোনে তিনি বলেন, “কোনো অপরাধী কার্যকলাপ ঘটিয়ে ফেলার পরে অপরাধীরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য নিজেদের দোষ চাপাতে অন্য যেকোনো ব্যক্তির নামই উল্লেখ করতে পারে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করার পর তদন্ত কর্মকর্তারাই সত্য উদঘাটন করবেন।”
স্থানীয় আইনজীবীদের সংগঠনের প্রধান সাখাওয়াত গত বৃহস্পতিবার আরো বলেছিলেন, “বুধবার আরিফ তার বক্তব্যে যা যা স্বীকার করেছেন তার সঙ্গে আজ রানার দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যের বেশ মিল রয়েছে।”
এর আগে আরিফ তার দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে ২৩ জন র্যাব সদস্য এবং রাজনৈতিকভাবে খ্যাত গডফাদারসহ বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তির নামও উল্লেখ করেছিলেন। আর আরিফের উল্লেখ করা নামগুলোই গতকাল স্বীকারোক্তি দেয়ার সময় রানাও উল্লেখ করেন এবং এসব নামের মধ্যে তাদের নামও রয়েছে যারা এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি পর্যায়ের কথাই ধাপে ধাপে বর্ণনাও করেছেন তিনি। পুরো ঘটনাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি পরিষ্কার বর্ণনা প্রদান করেছেন তিনি যা রেকর্ডও করেছে আদালত।
সাখাওয়াত বলেন, “আপনারা সবকিছুই জানতে পারবেন। কিন্তু চলমান তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ আদালত সূত্রে জানা গেছে, স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যগুলো যারা গ্রহণ করেছেন তারাই নিশ্চিত করেছেন যে, আরিফ ও রানা- দুজনই প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্তদের দুজনই বলেছেন যে, জিয়ার সহযোগিতায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনই হত্যার পুরো পরিকল্পনাটি সাজিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে এই জিয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হয়নি সূত্রটি।
আর রানার বক্তব্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আরিফ ও তারেকসহ র্যাব-১১’র ২৮-৩০ জন সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র।
সূত্রটি আরো জানায়, গত ২৭ এপ্রিল বিকালে নারায়ণগঞ্জের লিংক রোড থেকে অপহরণ থেকে শুরু করে তাদের মৃতদেহগুলো শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়া পর্যন্ত পুরো সময়জুড়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন নূর হোসেন।
আদালতের একটি সূত্র জানায়, অপহরণের পর যে দুটি গাড়িতে করে ওই সাত ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই গাড়ি দুটিকে ঘিরে রেখেছিল র্যাবের বেশ কয়েকটি গাড়ি। এরপর তাদের দুটি মাইক্রোবাসে ওঠানো হয় এবং চেতনানাশক ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তাদের অচেতন করে ফেলা হয়। এরপর তাদের মাথা পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়। পরে তাদের মাইক্রোবাসের মধ্যে রেখেই মাইক্রোবাসগুলো নিয়ে অপহরণকারীরা নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতে থাকে এবং রাতে কাঁচপুর ব্রিজের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় গিয়ে সেখান থেকে ট্রলারে করে শীতলক্ষ্যা নদীতে নিয়ে তাদের দেহগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হয়। দেহগুলো যেন নদীতে ভেসে না ওঠে তা নিশ্চিত করতে নদীতে ছুঁড়ে ফেলার আগে হত্যাকারীরা দেহগুলোর সঙ্গে ইটভর্তি বস্তা বেঁধে দেয়।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে সাখাওয়াত বলেন, “তদন্তে এখনো পর্যন্ত যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।” তবে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য নিয়ে নিজের আংশিক সন্তোষের কথাও জানান সাখাওয়াত।
তিনি আরো বলেন, “অভিযুক্তরা যে এখনো গ্রেফতার হননি, সেটাই আমার দুশ্চিন্তার বিষয়। একবার যদি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয় তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে।”
গতকাল রাত সোয়া ৯টার দিকে যখন এই প্রতিবেদনটি লেখা হচ্ছিল তখন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জানানো হয়, বেশ কিছু অজ্ঞাত লোক সাখাওয়াতকে অনুসরণ করতে শুরু করেছেন বলে এখন অনিরাপত্তার ঝুঁকিতে ভুগছেন তিনিও। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এই বিষয়ে স্থানীয় থানাকে অবহিতও করেছেন আইনজীবী সাখাওয়াত।
পরে সাখাওয়াত বলেন, “সকাল সোয়া ৬টার দিকে যখন আমি আমার গাড়ি রাখতে আদালতের গাড়ি পার্কিং চত্বরে গিয়েছিলাম তখন চারজন লোক আমার পথরোধ করে। তাদের সবাইকেই আমার কাছে প্রতিরক্ষা বিভাগের লোকের মতো লেগেছে। অতি উৎসাহী হিসেবে আখ্যায়িত করে আমাকে প্রয়োজনে গুম করে ফেলা হবে এবং আমার দেহও কেউ খুঁজে পাবে না বলেও তারা আমাকে হুমকি দেয়।”
এদিকে, স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে এবং নাম উঠে এসেছে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির- নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই বিষয়ে তদন্তের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রহস্য সমাধান করতে হলে উদঘাটিত যেসব তথ্য নিয়ে কাজ করা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং মনে হবে সেগুলো নিয়েই তদন্তকারীদের কাজ করা প্রয়োজন