ঊর্ধ্বতন কর্তার নির্দেশে খুন, পরিকল্পনায় নূর হোসেন

0
135
Print Friendly, PDF & Email

র‌্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে এবং নূর হোসেনের পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ঘটানো হয়৷ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে র‌্যাব-১১-এর ৩২ জন জড়িত ছিলেন৷
র‌্যাব-১১-এর সাবেক কর্মকর্তা লে. কমান্ডার এম এম রানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানেই তিনি এমন তথ্য দেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে৷
এর আগের দিন বুধবার র‌্যাবের আরেক সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন একই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন৷ সূত্রমতে, তিনিও দাবি করেছেন, র্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে তাঁরা ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন। আরিফ অবশ্য র‌্যাবের ১১ জন হত্যায় জড়িত বলে তথ্য দিয়েছিলেন৷
সূত্র জানায়, এম এম রানা তাঁর জবানবন্দিতে কার নির্দেশে, কার পরিকল্পনায় সাতজনকে কীভাবে, কোথায় হত্যা করা হয়েছিল, হত্যাকাণ্ডে কে কে যুক্ত ছিলেন, ইট, রশি, বস্তা কীভাবে নেওয়া হয়েছে, কোন কোন যানবাহন ব্যবহার করা হয়েছে, শীতলক্ষ্যা নদীতে কীভাবে লাশগুলো ফেলা হয়েছে—এসব বিষয় বর্ণনা করেন৷ কোন স্তরে কার কী অংশগ্রহণ—তা-ও তিনি বলেছেন বলে সূত্র জানায়।
সূত্রমতে, লে. কমান্ডার রানা তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, র‌্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে নূর হোসেনের পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় সাতজনকে অপহরণ করে নিজেদের গাড়িতে ওঠানোর পরপরই ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করা হয়৷ এরপর গাড়িতেই তাঁদের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পরে তাঁদের নিয়ে গাড়ি নরসিংদীর দিকে যায়। একপর্যায়ে নূর হোসেনকে মুঠোফোনে ফোন করেন তাঁরা। ফোনে নূর হোসেনকে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে নদী দখল করে তাঁর গড়ে তোলা অবৈধ বালু ও পাথরের ব্যবসাকেন্দ্রের লোকজন সরিয়ে ফেলার জন্য বলা হয়। রাত ১১টার দিকে তাঁরা কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পৌঁছান। অপহরণের ঘটনার পর থেকেই তাঁদের সঙ্গে সিও লে. কর্নেল তারেকের বারবার কথা হয়। পরে কাঁচপুরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন তারেক।
জবানবন্দিতে বলা হয়, একপর্যায়ে আদমজী ক্যাম্প থেকে ইট, বস্তা ও দড়ি আনা হয়। এখানেই লাশগুলো বস্তায় ভরে তাতে ইট বাঁধা হয়। পরে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে আসা হয়। ট্রলারে লাশ তুলে শীতলক্ষ্যা নদীর কলাগাছিয়া শািন্তনগর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রলার থেকে একে একে লাশ ফেলা হয় নদীতে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় রানাকে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আনা হয়৷ জবানবন্দি দেওয়া শেষ হলে তাঁকে বিকেল পৌনে চারটার দিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফজলুর রহমান বলেন, এম এম রানাকে আদালতে আনার পর তিন ঘণ্টা চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তিন ঘণ্টা পর তিনি স্বেচ্ছায় সাত খুনের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নিজেকে জড়িয়ে জবানবন্দি দেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনিসহ গ্রেপ্তার হওয়া র্যাবের তিন সাবেক কর্মকর্তা এবং নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত। বুধবার র্যাবের আরেক সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তার সঙ্গে লে. কমান্ডার এম এম রানার জবানবন্দির ঘটনাগত মিল আছে। মেজর আরিফও বলেছিলেন, নূর হোসেনের সহযোগিতায় এ ঘটনা ঘটেছে। তাঁদের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেকও ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. জাকারিয়া জানান, কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলামের করা মামলায় র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা এম এম রানা পাঁচ দিনের রিমান্ডে ছিলেন। কিন্তু চতুর্থ দিনে রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণের পর হত্যা ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়ির চালক ইব্রাহিমকে অপহরণের পর হত্যা—এ দুটি মামলাতেই র্যাব-১১-এর নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের অধিনায়ক এম এম রানা আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেন, জবানবন্দিতে রানা দাবি করেছেন, তিনিসহ র্যাব-১১-এর যাঁরা এ ঘটনায় জড়িত, তাঁরা র্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র। বিশেষ বাহিনীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যে আদেশ দেন, সেটাই মানতে হয়। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আইনজীবী সমিতির সভাপতি র্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তার স্বীকারোক্তিতে আরও যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দাবি জানান৷ এ দাবিতে আইনজীবীরা গতকাল বিক্ষোভ মিছিলও করেন৷

শেয়ার করুন