নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া র্যাবের তিন কর্মকর্তাসহ ওই বাহিনীর আরও কয়েকজন সদস্য, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা জড়িত বলে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
গতকাল মঙ্গলবার হাইকোর্টে দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সিআইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপহরণ এবং অপহরণ-পরবর্তী নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও লাশ গুমের ঘটনায় জড়িত। তবে টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সূত্র গতকাল বিকেলে প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের নির্দেশ মেনে সিআইডির পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে কী আছে, তা তিনি জানাতে চাননি।
নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ ও খুনের ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে ৫ মে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। এতে সাতজনকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যের গাফিলতি আছে কি না, এটিসহ পুরো ঘটনা তদন্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়৷ এ ছাড়া আদালতে এ ঘটনা নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক ও সিআইডির প্রধানকে পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আদেশ দেন৷ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার পুলিশ এবং র্যাবও পৃথক অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে৷ গতকাল সর্বশেষ প্রতিবেদনটি দাখিল করে সিআইডি৷ পুলিশ ও র্যাবের প্রতিবেদন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি৷
আদালত সূত্র জানায়, সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত খুনের ঘটনায় র্যাব-১১-এর তিন কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এর মধ্যে ফতুল্লা থানায় দায়ের করা দুটি মামলায় র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এর বাইরে আরও ১৪ জনকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের দফায় দফায় রিমান্ডে এনে মামলার মূল তদন্তকারী কর্মকর্তা, জেলা গোয়েন্দা শাখা ও সিআইডি পুলিশ পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ জিজ্ঞাসাবাদের সময় র্যাবের তিন কর্মকর্তা এ ঘটনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন৷ তদন্তে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে৷
সিআইিডর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ ঘটনায় আসামিদের ব্যবহার করা মোবাইল ফোনের কথাবার্তার রেকর্ড এবং অপহরণ ও হত্যার স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য মিলেছে৷ অপহরণ, খুন ও গুম করার সঙ্গে আরও কারা জড়িত, কে কীভাবে কাজ করেছে এবং কে কীভাবে সহায়তা করেছে, সে ব্যাপারে পাওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে৷
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্তকারীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে এ ঘটনায় র্যাবের গ্রেপ্তার হওয়া তিন কর্মকর্তা ছাড়া আরও কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন৷ র্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার ব্যাপারে দুজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীও ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ সাতজন প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ পেয়েছে। তাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম ও তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ে রাবেয়া আক্তার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন৷ তাঁরা আদালতে বলেন, তাঁদের চোখের সামনেই র্যাব কয়েকজনকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়৷ তবে যাদের তুলে নেওয়া হয়েছে, তাদের কাউকেই তারা চেনেন না। তুলে নেওয়ার সময় একজনের ঘাড়ে পিস্তল নিয়ে আঘাত করতে দেখেন। যাকে আঘাত করা হচ্ছিল তার মুখে দাড়ি ছিল। আর যিনি আঘাত করছিলেন, তিনি সাদা গেঞ্জি ও সাদা রঙের প্যান্ট পরা ছিলেন৷ ঘটনার সময় একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস, দুটি র্যাবের পিকআপ ও দুই কার ওই স্থানে ছিল বলে তাঁরা সাক্ষ্যতে উল্লেখ করেন৷
সিআইডির প্রতিবেদনে পলাতক নূর হোসেনের ব্যাপারে বলা হয়, মামলার এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল পরোয়ানা জারি করেছে৷ নূর হোসেনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে৷ তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়৷ নূর হোসেনসহ সব আসামির ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷
গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন৷ এর তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল ছয়জনের এবং পরদিন আরও একজনের লাশ শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে৷