আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য বাজেটে ব্যাংক খাতের জন্য কোনো সুখবর নেই, বরং বরাবরের মতো এবারো বহন করতে হবে বাড়তি করের বোঝা। উচ্চ হারে করপোরেট ট্যাক্সের পাশাপাশি ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের ওপর কোনো ছাড় দেয়া হচ্ছে না। ছাড় দেয়া হচ্ছে না ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্রম ও জাকাতের ওপর। আমানতকারীদের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর কর্তন ও কর শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) না থাকলে ১৫ শতাংশ কর কর্তনের খড়গ তো থাকছেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক খাতের ঘাটে ঘাটে কর দিতে গিয়ে প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে, যার দায়ভার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনসাধারণের ওপরই বর্তাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের মুনাফার ওপর করপোরেট ট্যাক্স সাড়ে ৪২ শতাংশই অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার না কমার অন্যতম একটি কারণ হলো করপোরেট ট্যাক্স। তারা জানিয়েছেন, সর্বাধিক মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠান মোবাইল কোম্পানিকেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি হলে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হচ্ছে ৩৫ শতাংশ হারে। ব্যাংক বাদে অন্য কোনো লিমিটেড কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তাদেরকে করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয় ৩৫ শতাংশ। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি না হলে ট্যাক্স দিতে হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। অথচ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মুনাফার ওপর করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয় সাড়ে ৪২ শতাংশ হারে। তুলনামূলক বেশি হারে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় সরাসরি কমে যায়। এ কারণে অধিক হারে মুনাফা করতে ব্যাংকগুলো আগ্রসী ব্যাংকিং করে থাকে। ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেড়ে যায়, যা প্রকারান্তরে সাধারণের ঘাড়ে এসে চাপছে। কেননা, উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে পণ্যের বাড়তি মূল্য গুনতে হয় সাধারণের।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নানাভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর করের বোঝা চাপানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের ওপর প্রভিশন রাখতে হয়। ওই প্রভিশন গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সংরক্ষণ করা হলেও এর ওপর সাড়ে ৪২ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করতে হয়। ইসলামি ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হয়। এ জাকাতকে ট্যাক্স আইনে ব্যয় হিসেবে ধরা হয় না। ফলে জাকাত দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর জাকাতের পাশাপাশি সমহারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এসব বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিবেচনা করতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব বিষয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে না। অর্থাৎ আগের হারেই ব্যাংকগুলোকে কর পরিশোধ করতে হবে।
এ দিকে সব শ্রেণীর আমানতকারীর মুনাফার ওপর অগ্রিম আয় কর কেটে রাখা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আর কর শনাক্তভুক্ত নম্বর (টিআইএন) না থাকলে এক লাখ টাকার ওপর আমানতকারীদের মুনাফার ওপর কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। ব্যাংকারদের মতে, দেশের ব্যাংক খাত বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়ে সাধারণের মাশুল দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে। ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিককালের সার্কুলারের কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের বেশি পরিমাণ প্রভিশন রাখতে গিয়ে প্রকৃত আয় কমে যায়। ব্যাংকারদের মতে, প্রভিশন ব্যাংকের বকেয়া ভিত্তিক অ্যাকাউন্ট হিসেবে স্থানান্তর করা হয়। আয়কর আইনে বকেয়া ভিত্তিক অ্যাকাউন্টের ওপর অর্জিত আয়কে কর রেয়াতের সুবিধা পায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তা বকেয়া অর্থাৎ ব্যয় হিসেবে আয়কর আইনে গণ্য করে না। এর ফলে একটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১০০ কোটি টাকা হলে আর ওই ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ ৬০ কোটি টাকা হলে প্রকৃত আয় নেগেটিভ অর্থাৎ লোকসান গুনতে হয়। এসব বিষয়ে বিবেচনা করতে বলা হয়েছিল আগামী অর্থবছরের বাজেটে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও বাজেটে ব্যাংকারদের জন্য কোনো সুখবর থাকছে না।
ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমকে বাংলাদেশ ব্যাংক অধিক হারে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সিএসআর কার্যক্রমে উৎসাহিত করতে ব্যাংকের বার্ষিক অর্থনৈতিক মানদণ্ডের সূচকে (ক্যামেলস রেটিং) সিএসআরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যাংক যত বেশি সিএসআর করবে মানদণ্ডের সূচকে ওই ব্যাংক তত ভালো নম্বর পাবে। ব্যাংকারদের দাবির পরও আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতামুক্ত করা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।