মোদি ম্যাজিকে ভারতের পথচলা শুরু

0
143
Print Friendly, PDF & Email

২৬ মে রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বরে চার হাজার অতিথির সামনে শপথ নিলেন ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হিন্দুত্ববাদের নব্য নেতা নরেন্দ্র মোদি। সঙ্গে তার ৪৫ সদস্যের মন্ত্রিসভা। আটটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি ছিল এক চমক। তার মধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সবচেয়ে দৃষ্টি কেড়েছেন এবং মিডিয়ার সেরা আকর্ষণ ছিলেন। ভারত-পাকিস্তানের শীতল সম্পর্কের বরফ গলার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন নওয়াজ। অচিরেই দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হবে বলে তিনি আশা করেছেন এবং তার সফর দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মুখোমুখির একটি অনন্য সুযোগ বলে অনেকেই চটকদার ও সমঝদার মন্তব্য করেছেন। যদিও তার ভারত সফরকে বাস্তবায়ন করতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান তার সফরে বাগড়া দিয়েছিলেন। গদি হারিয়ে কংগ্রেসও নওয়াজকে আমন্ত্রণের সময় হয়নি বলে মোদিকে নিরুৎসাহিত করেছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিজেপির আগ্রহ হঠাৎ যেন সময়ের আগে পাল্লা দিয়েছে। মোদি কিন্তু পাকিস্তানকে সম্পর্ক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে জঙ্গিদের পাকিস্তানের মাটিকে পশ্চাৎভূমি হিসেবে ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করার কথা সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন। দাবি করেছেন ২০০৮ সালের ২৬/১১ জঙ্গি হামলায় অভিযুক্তদের বিচার ত্বরান্বিত করতে। নওয়াজ শরিফ কাশ্মীরের কথা বেমালুম চেপে গেলেন, যা সবার কাছে একটু আশ্চর্য লেগেছে। দুই দেশের বাণিজ্য উন্মুক্ত করতে নওয়াজের আগ্রহ ছিল বেশি। পাকিস্তান তার পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের উভয় প্রতিবেশীর আস্থা হারিয়ে কিছুটা হলেও একলা হয়ে পড়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তির পথে এগুনো পাকিস্তানের রাজনীতির নতুন কৌশল হলেও সামরিক কর্তাদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে ইতিমধ্যে সংশয় রয়েই গেছে। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যেই নওয়াজের সফরের প্রতিবাদ করেছে, যদিও সংসদে তাদের মাত্র চারটি আসন রয়েছে। বিজেপির নির্বাচনী নেতা মোদি আর ক্ষমতায় আসীন মোদির মধ্যে এক বিস্তর পার্থক্য প্রদর্শন কি মোদির আর এক চমকানো ম্যাজিক হবে? এটা নিয়ে অনেকেই ভাবছেন। কংগ্রেস যা পারেনি তার গত এক দশকের শাসনামলে মোদি তা প্রথমেই করে সবাইকে চমকে দিয়ে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে চাচ্ছেন।

গত অর্ধ দশকে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো হলেও বিদ্যমান বিরোধ মেটাতে কংগ্রেস সরকার পদক্ষেপ নিয়েও নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আস্থা অর্জন করতে মোদি শুরুতেই উদ্যোগী হয়ে পড়েছেন। তাই আমন্ত্রণ করেছেন সার্ক দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের। সবাই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মোড়ল হিসেবে মোদিকে মেনে নেওয়ার সম্মতি দিয়ে এলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্ব্বী পাকিস্তানসহ সব প্রতিবেশী দেশ। যদিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাপান সফরের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির কারণে যেতে না পেরে সংসদের স্পিকারকে পাঠিয়েছেন। মোদির উগ্রজাতীয়তা বোধের কারণে তার সরকারের কাছে প্রতিবেশীরা কী আচরণ পাবে সেটা নিয়ে বাংলাদেশসহ সবার মধ্যে শঙ্কা কিছুটা হলেও সৃষ্টি হয়েছে। মোদির এই আমন্ত্রণ শুধু কুশল আর শুভেচ্ছা বিনিময়ে সীমাবদ্ধ নয়, নিঃসন্দেহে সবাইকে আশ্বস্ত করার একটি মোদি ম্যাজিক।

গুজরাটের উন্নতির আদলে সারা দেশকে উন্নত করতে হলে ভারতের সীমানায় সীমাবদ্ধ থেকে যে সম্ভব নয়, সেটা বাণিজ্য চৌকস মোদি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছেন। তাই আঞ্চলিক অবাধ বাণিজ্য ও যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরিতে মোদি বেশি গুরুত্ব দেবেন সেটা কিছুটা পরিষ্কার মনে হচ্ছে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বাড়িয়ে আঞ্চলিক নেতৃত্বে তার অবস্থান পাকা করাটাও হবে আর একটা মোদি ম্যাজিক। বঙ্গোপসাগর অর্থনৈতিক সহযোগিতা উদ্যোগে তার আগ্রহ বাড়বে একই কারণে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের অতীত ধরন নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের স্বার্থ ও অভিলাষের সঙ্গে সম্পূরক নয়, তা মনমোহন সিং অনেক আগেই অনুধাবন করে গত এক দশক ধরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন ধাঁচ তৈরি করলেও তার ফসল তুলতে সক্ষম হননি। ২০১২ সালে তার সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা পানি চুক্তি করতে ব্যর্থতা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।

উপমহাদেশের বাইরের পরাশক্তির সঙ্গে কৌশলগত অংশীদার তৈরিতে ভারতের আকাঙ্ক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে পররাষ্ট্রনীতিতে। ভারত মহাসাগরে আধিপত্যের অভিলাষ বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য দক্ষিণ এশিয়াকে একক ভূ-রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ভারত দেখতে চায়। চীন ও মার্কিনিদের বিষয়টি মেনে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আলাদা থাকার দুর্ভোগ এড়াতে চায় ভারত। দক্ষিণ এশিয়াকে একক সত্তায় রূপান্তর করতে মোদির নতুন দ্রুত চলার নীতি আর একটি ম্যাজিক হবে বলে মনে হচ্ছে।

ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মানেকা গান্ধীকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে গান্ধী পরিবারের কংগ্রেসকে যেন আর একটু ধাক্কা দিলেন মোদি। গান্ধী রাজত্বের শেষ আলোকবর্তিকা সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী অতিথির আসনে সামনের সারিতে অবসাদমাখা মুখ নিয়ে দেখছিলেন শপথ অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মুখেও ছিল না তৃপ্তির হাসি। হয়তো ভাবছিলেন বারবার কংগ্রেসের এই শোচনীয় পরাজয়ের দায়ভার মাথায় নিলেও মোদির ম্যাজিক ঠেকাবেন কীভাবে। হিন্দুত্ববাদী কট্টর মোদি একজন মুসলিমকে মন্ত্রী বানিয়ে সেক্যুলার রাজনীতিকে আর একটু বিপদে ফেলে দিয়েছেন। হিন্দুত্ববাদী মোদি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক ভারতকে নতুন মাত্রা দিতে নিজের কট্টর ভাবমূর্তি থেকে সর্বজনগ্রাহ্য মূর্তিতে পরিবর্তিত করতে খুব সময় নেবেন না। ক্ষমতার প্রথম দিন থেকেই তিনি আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছেন। তিনি ভারতের প্রশাসনকে জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য ঢেলে সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মন্ত্রীদের ১০০ দিনের কাজের লক্ষ্য নিতে বলেছেন এবং নিজে সুস্পষ্ট অগ্রাধিকার ঠিক করে দিয়েছেন। ভারতের বহির্মুখী অভিলাষের জন্য প্রতিরক্ষায় জোর দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী উভয় ক্ষেত্রেই তার একনিষ্ঠতা, আগ্রহ ও ক্ষমতা যেন কিছুটা হলেও ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। ভারতের জনগণের মোদি ম্যান্ডেট যেন সবাইকে তার ওপর অকৃত্রিম ও প্রশ্নাতীতভাবে আস্থাশীল করেছে, যেটা মোদি ম্যাজিকের জাদুর কাঠি।

বাংলাদেশ নিয়ে মোদি তাড়াহুড়া করতে চাইবে না, কারণ বঙ্গোপসাগর অর্থনৈতিক উদ্যোগের বাংলাদেশ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতু। দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয় যেমন তিস্তা পানিচুক্তি ও সীমান্তচুক্তি ১৯৭৪ নিষ্পত্তির শেষ ধাপে রয়েছে। এ দুটি নিয়ে তিনি ভেবেচিন্তে এগুবেন বলে মনে হয়। ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন চুক্তিটিই থাকবে ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল হিসেবে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অন্য দেশের মতো ভারতের কাছেও পরিষ্কার। দক্ষিণ এশিয়াকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একত্রীভূত ও পারস্পরিক নির্ভরশীল অর্থনীতি ও অবকাঠামোতে রূপান্তরিত করতে বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশের প্রতি কংগ্রেসের ব্যর্থতা মোদি তার প্রথম সফরেই ঢেকে দিয়ে সফলতার ষোলআনাই নিজের ঝুলিতে নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে একটু চমকে দিয়ে আর একটা ম্যাজিক দেখাতে পারেন। বিদ্যুৎ, আঞ্চলিক মহাসড়ক, গ্যাস পাইপলাইনসহ চীন, মিয়ানমার, বাংলাদেশ-ভারত রেলপথ ও মহাসড়ক এক নতুন এশিয়ান অর্থনীতির জন্ম দেবে। পরবর্তীতে একদিকে দক্ষিণ এশিয়া ও অপরদিকে মধ্য এশিয়া হয়ে ইউরোপ ও আফ্রিকার সংযুক্তি বিশ্বের নতুন অর্থনৈতিক স্থাপত্যের কাঠামো তৈরির প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়ার কৃতিত্ব মোদি নেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে অনেকেই মনে করেন। বাংলাদেশ এই সমীকরণের অঙ্গীভূত অংশ, তাই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন দিক খুঁজে পেতে ভারতকেই বেশি অগ্রণী হতে হবে নিঃসন্দেহে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে গোড়াপত্তন হয়েছে তার ধারাবাহিকতা থেকে সরে আসার কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। মনমোহনের পররাষ্ট্রনীতি ও অনুসৃত কৌশল থেকে মোদি সরে না এসে তার স্থবিরতা দূরীকরণে তিনি যত্নবান হবেন এমনটিও আশা করা যায়।

শেয়ার করুন