শিল্পোৎপাদন কমছে বাড়ছে বেকারত্ব

0
200
Print Friendly, PDF & Email

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা এবং উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে দেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় কমে আসছে বিদ্যমান বিনিয়োগও। ফলস্বরূপ নতুন কর্মসংস্থান তো হচ্ছেই না, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কর্মজীবীরাও। কমছে রাজস্ব আহরণ, বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন পর্যায়ে এমন মন্দাবস্থা চলতে থাকলে জাতীয় অর্থনীতির ওপর এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উয়িং কর্তৃক প্রাক্কলিত প্রাথমিক হিসেবে বলা হয়েছে, শিল্পখাতের বৃহৎ ও মাঝারি উপখাতে গত অর্থবছরের চেয়ে এ বছর প্রবৃদ্ধি কমেছে ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ উপখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর হালকা শিল্প উপখাতে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ২ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ উপখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ।
উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি হয়। গত এক বছরের অস্থিরতায় তাদের কাজ পাওয়ার সুযোগ তো হয়ইনি, উল্টো কর্মহীন হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ কর্মজীবী। গত ছয় মাসে কেবল তৈরী পোশাক শিল্পখাতে চাকরিচ্যুত হয়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। এ সময় দেশে নতুন করে কোনো কারখানাই গড়ে ওঠেনি। চালু হয়নি বন্ধ থাকা কয়েক হাজার কারখানার একটিও।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের (বিওআই) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালে দেশে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ৪২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ১৯৭টি। ২০১২ সালে এক হাজার ৬৫৫টি শিল্প প্রকল্পে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৭৮ কোটি ছয় লাখ টাকার। অর্থাৎ বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০১৪ সালের প্রথম চার মাসে বিনিয়োগ নিবন্ধনের হার আগের বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
বিনিয়োগ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিদেশী বিনিয়োগ নিবন্ধন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এ সময় ছয়টি শতভাগ বিদেশী এবং ১৫টি যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা। অথচ আগের প্রান্তিকে ২১টি শিল্প প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৭০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বিওআইয়ের তথ্য থেকে দেখা যায়, আগের বছরের চেয়ে ২০১৩ সালে শিল্প প্রকল্পের প্রস্তাব বেশ কমেছে। ২০১২ সালে যেখানে এক হাজার ৮৫৫টি প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছিল, গত বছর তা নেমে আসে এক হাজার ৩৭৮টিতে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্পখাতে। চলতি অর্থবছরে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে তারা পূর্বাভাস দিয়েছে বেশ আগেই। প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশীয় বাজারের সীমিত আকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অনুন্নয়নকে এ খাতের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি কম হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণও।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশের মোট কর্মসংস্থানের অন্তত ৩ শতাংশ মানুষ জড়িয়ে আছে নির্মাণ খাতের সাথে। গত তিন বছরে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ তো হয়ইনি, আটকে আছে ৯৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। ত্রিশ হাজারের বেশি নির্মিত ফ্যাট বিক্রি না হওয়ায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে পুরো শিল্প সেক্টরে। এর প্রভাবে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে রি-রোলিং, সিমেন্ট, ব্রিকফিল্ডসহ অনেক উপখাতেই। সুসংবাদ নেই বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও। সরকারের উদাসীনতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈরী সম্পর্কের কারণে বিদেশে কর্মী প্রেরণ প্রায় বন্ধই হয়ে আছে। কৃষি, পোলট্রি, পাট, চা, চামড়ার মতো শিল্পগুলোতেও চলছে নানাবিধ হতাশা।
বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের দুরবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে রফতানিমুখী শিল্পখাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ৪২টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ফেডারেশন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে একজন শিল্পোদ্যোক্তার জন্য এটি কোনোভাবেই সুবিধাজনক নয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট তো আছেই, রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বিবেচনার বিষয়। এমতাবস্থায় বিদ্যমান বিনিয়োগ নিয়ে উদ্যোক্তারা যখন চরম বিপাকে তখন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে নতুন কর্মসংস্থান তো দূরের কথা, বিদ্যমান কর্মীদের ধরে রাখাই কঠিন। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

শেয়ার করুন