সরকারবিরোধী আন্দোলনে নীরবতার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। কিছুটা ধীরগতিতেই জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমেই দেশব্যাপী ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে চায় দলটি। সরকারবিরোধী জনমত আরও দৃঢ় হওয়ার জন্য আর কিছুটা সময় দিতে চায়। এ কারণেই রাজধানীতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সভা-সমাবেশ করতে না দিলেও জোরালো কোনো প্রতিবাদ করছে না তারা। তবে সরকারের এসব কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ ও বহির্বিশ্বের গোচরে আনার চেষ্টা চলছে। এ প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘সরকার পচতে শুরু করেছে। এ জন্য আমরা তাদের সময় দিতে চাই। আরেকটু পচলেই আন্দোলন। আগামী দিনে আওয়ামী লীগের বিদায় হবে করুণভাবে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারের ব্যর্থতা ও অপকর্মে জনগণের অতিষ্ঠতার মাত্রা আরও ব্যাপক আকার ধারণের সুযোগ দিতে চায় বিএনপি। এ জন্য কিছুটা অপেক্ষার কথাই বলেছেন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে আপাতত হরতাল, অবরোধের মতো বড় আকারের কোনো কর্মসূচি না দিলেও আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার পর সব ধরনের কর্মসূচিতেই যাবে তারা। রাজপথবিমুখ কেন্দ্রীয় নেতাদের সক্রিয় করতে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজেই মাঠে নামছেন আগামী মাসের শুরু থেকে। জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে তিনি নিয়মিত অফিস করতে যাচ্ছেন নয়াপল্টনের প্রধান কার্যালয়ে। পাশাপাশি প্রতি মাসেই ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন ইস্যুতে সমাবেশ করবেন। সরকার বাধা দিলে তা সাধারণ মানুষসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের গোচরে আনার ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি চলবে বৈদেশিক কূটনৈতিক তৎপরতা।
পাশের দেশ ভারত থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য পর্যন্ত বড় মাপের দেশগুলোসহ সব আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও জোর লবিং-তদবির অব্যাহত রাখা হয়েছে। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতে নবনির্বাচিত মোদি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে তো একেবারে শুরু থেকেই উল্লেখযোগ্য তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবিসহ সরকার পরিবর্তনের ঘটনায়ও সারা দেশে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকটা চাঙ্গাভাব দেখা গেছে। বিশেষ করে বিরোধী মতের ওপর চলমান দমন-পীড়নের কিছুটা হলেও অবসান ঘটবে বলে আশা করছেন বিএনপির লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমেও আগের চেয়ে অনেকটা চাঙ্গা হয়েছেন তারা। সামনে রমজান, তার ওপর বর্ষা। চলছে সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম। এসব কারণে বৃহৎ আকারের কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে নীরবতার কৌশলেই এগোচ্ছে দলটি। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারক তরিকুল ইসলাম তা অস্বীকার করে বলেন, ‘নীরবতার তো প্রশ্নই ওঠে না। বিএনপির আন্দোলন চলছে এবং তা অব্যাহত আছে। সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, মিছিল, গণঅনশন, জনসংযোগ, পেশাজীবীদের জনসভায় খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ, বক্তৃতা-বিবৃতি এগুলোকে কি আপনাদের আন্দোলন মনে হয় না? শুধু হরতাল, অবরোধই বড় আন্দোলন কর্মসূচি_ তা আমরা বিশ্বাস করি না। সারা দেশে এখন আমাদের জনমত তৈরির কর্মসূচি চলছে। ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকভিত্তিক জনসম্পৃক্ততা ঘটানো হবে। অতঃপর সময় ও প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের কর্মসূচিই দেওয়া হবে। আর ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের এ সরকার গায়ের জোরে, নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে খুব বেশি দিন স্থায়ী হবে বলেও আমি বিশ্বাস করি না। একদিন না একদিন এর বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটবেই এবং সেদিন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের গণদাবিও আদায় হবে। আর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য যদি রোজ কেয়ামত পর্যন্তও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, তা-ও আমরা করতে রাজি। তবুও আওয়ামী লীগের মতো অগণতান্ত্রিক আমরা কখনোই হতে পারব না।’ দলের স্থায়ী কমিটির অন্য এক সদস্য জানান, ১৯৭৪ সালে যখন বিরোধী মতের মানুষের ওপর রক্ষীবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চলছিল, তখন মওলানা ভাসানী তার অনুসারী নেতা-কর্মীদের সাময়িকভাবে কিছু দিন চুপ করে থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন_ ‘তোরা আপাতত চুপ করে অপেক্ষা কর। দেখবি-আপনা-আপনিই এ পরিস্থিতির সমাধান হয়ে গেছে।’ এ চুপ করে থাকাটাও রাজনীতিরই অংশ। সময়মতো এটাও বড় ধরনের একটি রাজনীতি। সাময়িক এ কৌশলেও অনেক বড় মাপের ফল পাওয়া যায়।
তবে দলের আরেক নীতিনির্ধারক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘হরতাল-অবরোধ না দেওয়াকে আপনারা নীরবতা বলতে পারেন। কিন্তু আমি বলব, দেশের মানুষ ফুঁসে উঠছে। খুন-গুম-অপহরণে সর্বস্তরের জনগণ আজ চরমভাবে অতিষ্ঠ। এ সরকারকে তারা আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। মানুষের এ ক্ষোভই একসময় বিক্ষোভে পরিণত হবে, আর তখনই গণবিস্ফোরণটা ঘটবে এবং সরকারের পতন হবে। দিনক্ষণ দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন হয় না।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুর মতে, বিএনপি ধারাবাহিক আন্দোলনেই আছে। চূড়ান্ত আন্দোলন দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি প্রতিবাদ সমাবেশ, অনশন ও তিস্তার পানির দাবিতে লংমার্চ করেছে। সামনে শ্রমিক মহাসমাবেশ হবে। আর শনিবার আইনজীবীদের মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছে খুন-গুম-অপহরণের প্রতিবাদে। ২৮ মে মুন্সীগঞ্জের গুদারাঘাটে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জনসভা রয়েছে। তবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে আরও কিছুটা সময় লাগবে। বিএনপির বর্তমান নীরবতার কৌশল সম্পর্কে ঢাকা মহানগরী বিএনপির সদস্যসচিব আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা নীরব নই। আন্দোলন করছি।’ তিনি বলেন, “বেসিক্যালি আওয়ামী লীগই আর ক্ষমতায় নেই। দলটির রাজনৈতিক মৃত্যু হয়েছে সে ৫ জানুয়ারিই। এখন যা দেখছেন গায়ের জোরে অঘোষিত একদলীয় সরকার নিয়ে বসে আছে তারা। রাজপথে নামলেই সরাসরি গুলি, না হয় ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুম, খুন করা হচ্ছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। তিন শতাধিক নেতা-কর্মী নিখোঁজ। এ দমবন্ধ অবস্থার ‘সলিউশন’ তো একটা না একটা হবেই। তবে এ সলিউশনটা আমাদের কাম্য নয়।” তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়ায় শুধু বিএনপিরই নয়, আওয়ামী লীগের নিঃশ্বাসও একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এটুকু বলতে পারি, সময়মতো প্রয়োজনীয় সব ধরনের কর্মসূচিই দেওয়া হবে। সরকারের সময় যে শেষ হয়ে এসেছে, তা বুঝতে পেরেই দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার সর্বশেষ চেষ্টাটা করছে এখন।’ এদিকে জানা গেছে, নীরব রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি এখন সভা-সমাবেশে পুলিশি বাধার তেমন একটা প্রতিবাদ না করে বরং সরকারের এ ধরনের নেতিবাচক আচরণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দেশি-বিদেশি সমর্থন আদায়ের। এ জন্য কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে অঙ্গ সংগঠনের বেশির ভাগ কর্মসূচিই এখন জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিতর আয়োজন করা হচ্ছে। অবশ্য সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে বর্তমানে বড় ধরনের কোনো সহিংস কর্মসূচিতেও যাচ্ছে না বিএনপি। এ নিয়ে জোরালো কোনো কর্মসূচিতে না গিয়ে দু-একটি থানা ছাড়া নামকাওয়াস্তে রাজধানীতে এবং জিলায় জিলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে এ নীরবতাকেও আন্দোলনের ‘কৌশল’ হিসেবে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
সরকার রাজধানীর অন্য কোথাও সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ায় জাতীয় প্রেসক্লাবনির্ভর হয়ে পড়ছে দলটি। এমনকি প্রেসক্লাবে বেগম খালেদা জিয়ার অনুষ্ঠানেও এখন নেতা-কর্মীদের মুখে স্লোগান শোনা যায়_ ‘খালেদা জিয়ার ভয় নাই, প্রেসক্লাব ছাড়ি নাই’। তবে দলের সিনিয়র নেতাদের আরেকটি অংশ জনঅতিষ্ঠতা তুঙ্গে ওঠার জন্য সরকারকে আরও কিছুটা সময় দিতে চায়; যাতে মানুষ চরম অতিষ্ঠ হয়ে দল-মত নির্বিশেষে একদিন ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে সরকারের উদ্দেশে এও বলেছেন, বেশি দেরি করলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে চলে যেতে পারে। এরকম কিছু হলে বিএনপির এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা কোনো কাজেই আসবে না। এটাও হয়তো বিএনপির এ নীরব রাজনৈতিক কৌশলের আরেকটি কারণ হতে পারে।